মিডিয়া কীভাবে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে গণমানুষের সম্মতি উৎপাদন করে, সে বিষয়ে ১৯৮৮ সালে নোয়াম চমস্কি যখন তার ম্যানুফ্যাকচারিং বইটা লিখেছিলেন, তখনকার মিডিয়ার সাথে এখনকার মিডিয়ার পার্থক্য আকাশ-পাতাল। কাজেই প্রশ্ন আসতে পারে, চমস্কির সেই তত্ত্ব কী আজও প্রযোজ্য?
যে পাঁচটা পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে চমস্কি এবং তার সহ-লেখক হারম্যান তাদের “প্রপাগান্ডা মডেল” দাঁড় করেছিলেন, তার প্রথম দুইটিই ছিল গণমাধ্যমের মালিকানা এবং বিজ্ঞাপন। মালিকানার কথা থাক, আপাতত বিজ্ঞাপন নিয়েই আলোচনা করি, যেহেতু গত কয়েক দশকে সংবাদপত্র টিকেই ছিল মূলত বিজ্ঞাপনের উপর।
চমস্কি-হারম্যানের মতে গণমাধ্যম চালাতে যে বিশাল খরচ প্রয়োজন হয়, গ্রাহকদের কাছ থেকে সরাসরি তার ক্ষুদ্র একটা অংশই কেবল উঠে আসে। বাকিটুকুর জন্য গণমাধ্যমগুলোকে নির্ভর করতে হয় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের উপর। ফলে তাদেরকে শুধু নিজেদের মালিকদেরকে না, অন্যান্য বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও, অর্থাৎ দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকদেরকে সন্তুষ্ট রেখে চলতে হয়।
গণমাধ্যম শুধু যে গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রি করে, তা-ই না, একইসাথে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও নির্দিষ্ট মানসিকতার, নির্দিষ্ট শ্রেণীর পাঠক বা দর্শককে বিক্রি করে। আর প্রধান বিজ্ঞাপন দাতা বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোই যেহেতু ক্ষমতাসীনদেরকে ডোনেশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই ব্যতিক্রম ছাড়া গণমাধ্যমগুলো কখনোই ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
চমস্কি-হারম্যানের এই মডেল কয়েক দশক পর্যন্ত একচেটিয়াভাবে বিনা প্রশ্নে টিকে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মিডিয়ার চরিত্র এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে যে, এখন সময় এসেছে তাদের এই তত্ত্বকে রিভাইস করার। এই কাজটাই করার চেষ্টা করেছেন Postjournalism and the death of newspapers. The media after Trump: manufacturing anger and polarization বইয়ের লেখক Andrey Mir.
তার মতে, চমস্কির সময়ের মতো বর্তমানে মিডিয়া আর বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল না। বিজ্ঞাপনের অভাবে অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক পত্রিকা শুধু অনলাইনে শিফট করেছে, এবং যেসব পত্রিকা টিকে আছে, তাদেরও প্রধান আয় এখন আর বিজ্ঞাপন না, বরং ডোনেশন এবং সাবস্ক্রিপশন।
বিজ্ঞাপনদাতারা এখন আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় না, তারা বিজ্ঞাপন দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর সাধারণ মানুষও এখনও আর বেশি কিনে পত্রিকা পড়ে না, কারণ অধিকাংশ সংবাদ তারা সোশ্যাল মিডিয়া এবং কপিপেস্ট সাইটগুলোর কল্যাণে এমনিতেই পেয়ে যায়। পত্রিকাগুলো তাই টিকে আছে কেবল তাদের একান্ত ভক্তদের টাকার কল্যাণে, যারা নিউজফীডে ফ্রিতে নিউজ পাওয়ার পরেও ঐ পত্রিকাকে বা তার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য ডোনেশন দেয় বা সাবস্ক্রাইব করে।
পূর্বে যখন পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল ছিল, তখন বিজ্ঞাপনদাতারা নিজেদের স্বার্থেই চাইত সমাজের নানাবিধ শ্রেণী-পেশার এবং মতাদর্শের মানুষকে আকৃষ্ট করতে। ফলে তারা পত্রিকাগুলোর একটা চাপ রাখত বাস্তবতাকে বাস্তবের চেয়েও সুন্দরভাবে তুলে ধরতে। তারা চেষ্টা করত কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে যেন ঘৃণা ছড়ানো না হয়, কাউকে যেন এলিয়েনেট না করা হয়, এবং সমালোচনা ও বিরোধিতাগুলোও শালীনতার মধ্যে থাকে।
কিন্তু আন্দ্রেই মিরের মতে, বিজ্ঞাপনের সাথে সাথে সংবাদপত্রের সেই সুদিন শেষ। পত্রিকাগুলো এখন আর রিয়েলিটিকে বিউটিফাই করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। কারণ যত চেষ্টাই তারা করুক, সাধারণ মানুষ এখন আর তাদের পত্রিকা টাকা দিয়ে কিনবে না। কিন্তু তারা যদি একটা বিশেষ মতাদর্শের পক্ষ নেয়, সেই পক্ষে উগ্রভাবে লেখালেখি করে, ঘটনাপ্রবাহকে ড্রামাটাইজ করে, বিপক্ষের বিরুদ্ধে চরম আক্রমণ করে, কন্সপিরেসি ছড়ায়, তাহলে ঐ পক্ষের বা মতাদর্শের সমর্থকরা তাদের পত্রিকা যে শুধু কিনবে, তাই না, পত্রিকাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ডোনেশনও দিবে। টিকে থাকার তাগিদেই গণমাধ্যমগুলো তাই এখন সংকীর্ণ মনোভাবসম্পন্ন একটা শ্রেণীর পাঠকদেরকে তুষ্ট করতে গিয়ে নিজেরাই বায়াসড হয়ে পড়ছে।
চমস্কি বলেছিলেন, মিডিয়ার প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষকে বিনোদন দেওয়া এবং সংবাদ সর্বরাহ করা। বিনোদনের ব্যাপারটা ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া অনেক আগেই ছিনিয়ে নিয়েছে। পত্রিকা এখন আর মানুষকে বিনোদন দেয় না। বরং পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পত্রিকাগুলো মানুষের মধ্যে হতাশা এবং ঘৃণার জন্ম দেয়। তারা এখন যতটা না কনসেন্ট ম্যানুফ্যাকচার করে, তার চেয়ে বরং আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকা কনসেন্টকে আরো উস্কে দেয়। তারা এখন অ্যাঙ্গার তথা ক্ষোভ ম্যানুফ্যাকচার করে। মানুষের মধ্যে পোলারাইজেশন বৃদ্ধি করে।
স্বাগতম পোস্ট জার্নালিজমের যুগে।