রাষ্ট্র যদি দেহ হয়, তাহলে সেই দেহের বড় রোগ হলো দুর্নীতি নামের ক্যান্সার। যে কোনো রাষ্ট্রেরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একেবারে প্রথম সারিতে থাকেন সাংবাদিকরা, দুর্নীতি দমন কমিশন নয়। সাংবাদিকরাই সমাজরাষ্ট্রের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা ক্যান্সার জীবাণুরূপী দুর্নীতিগুলো তুলে আনেন। এরপরই সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন বিভাগসহ অন্য সংস্থাগুলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়।
একটি দেশের অগ্রগতির পথে বড় বাঁধা হলো এই দুর্নীতি। পুস্তকের ভাষায়, দুর্নীতি (ইংরেজি: Corruption) দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে। আমার মতে, দুর্নীতি হলো আদর্শিক পতনের সর্বোচ্চ ধাপ। অর্থাৎ, এমনকি ধর্মকেও যদি কেউ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করেন, সেটিও বড় দুর্নীতি। ধর্মীয়ভাবে পাপ, সেটি ত আছেই।
আমাদের দেশে দুর্নীতি বলতে ঘুষ প্রদানকে, সম্পত্তি আত্মসাৎকে এবং সরকারী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাকে দুর্নীতি বলে। অথচ এর পরিসর এরচেয়েও অনেক বড় ও বিস্তৃত।
দুর্নীতির সাথে ক্যান্সার কোষের তুলনা করেন অনেকে। ধরা যাক রাষ্ট্রের কোনো বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার তছরুপ হলো। কোনো ভূমিদস্যু কয়েকশ মাইল দখলে নিলো। সরকারি কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে সেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু যদি কোনো পুলিশ বা আনসার সদস্য ৫-১০ টাকা নিয়ে কোনো রিকসাকে উল্টোপথে যেতে দেয়, কোনো শিক্ষক এক হালি বড় ইলিশ পেয়ে যদি ছাত্র-ছাত্রীর পরীক্ষার খাতার নম্বর বাড়িয়ে দেয়— এসব ছোট ছোট দুর্নীতি হলে মনে করবেন দুর্নীতির ক্যান্সার কোষ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। এটিই বেশি ভয়ের। কারণ, এটা সারাতে নৈতিকতার কেমোথেরাপিতেও আর কুলাবে না। সমাজ একেবারে পচনের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। ভাগ্য যদি সহায় না হয়, তরুণ ও যুবসমাজ যদি জেগে না উঠে; ওই সমাজ উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
অর্থাৎ, ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সংকটের থেকে বেশি ভয় গলির মোড়ে মোড়ে, গ্রামের ছোট হাটবাজারে ছড়িয়ে পড়া ছোট ছোট দুর্নীতির সমস্যা।
দুর্নীতিকে এ কারণেই অনেকে ক্যান্সারের সাথে তুলনা করেন।
আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লেখা শেষ করছি। প্রথমে যে কথাটি বলছিলাম, দুর্নীতি বিরোধী প্রথম সারির যোদ্ধা হলেন সাংবাদিকরা। কিন্তু এ দেশে সেই সাংবাদিকরা কোনো লড়াইয়ে নেই। কেউ বেতন-ভাতায় পরিবারের ভরনপোষনের জন্য, কেউ বাড়তি আয়-রোজগার করে ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানোর জন্য সাংবাদিকতা করে থাকেন। খুব কম সংখ্যক সাংবাদিক মেলে যাদের মূল প্যাশন দেশ ও জনগণের পক্ষে কলম ধরা। কিংবা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুন্দর পরিবেশের একটি বাসযোগ্য দেশ রেখে যাওয়ার লড়াই জারি রাখা।
আমি বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে এ পেশার নৈতিক স্খলন নিয়ে অনেকদিন ধরেই লিখছি। এসব লেখালেখি করে এরমধ্যে বহু বিরাগভাজন পয়দা করেছি। বুঝতে পারি। তবে দিনশেষে নিজের কাছে নিজের কাজে তৃপ্তি পাই। সততায় অটল থাকার, মাথা নিচু না করবার সাহস নিয়ে মনে মনে গর্বিত হই। আমার কলম সংবাদ লেখার কাজে ভাড়ায় খাটতে পারে, কিন্তু কলমটি যে বিক্রি করে দেইনি আজও, তা ভেবে কিঞ্চিত স্বস্তি পাই।
লেখক, লুৎফর রহমান হিমেল, সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট. লাইভ