বাঙালি এমন জাতি তারা রবীন্দ্রনাথের শশ্মান যাত্রার সময় তাঁর চুল ছিঁড়ে নিয়েছিল! গুরুদেব তো আর নাই, তাইলে তাঁর চুলই সই—- এই জন্য।
বাঙালি গোঁড়া হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান দুই ধরনের মানুষদের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথকে সন্দেহ করার মতো লোক ছিল, — এখনো আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, এই এক কথা দিয়েই পুরো রবীন্দ্রনাথের উপর বাজিমাত করার সুযোগ হাত ছাড়া করেনি অনেকেই। আবার, রবীন্দ্রনাথ ঠিকঠাক হিন্দুই নন, তিনি অতি নিকৃষ্ট আগলা চটুল প্রেমের কথা লেখেন, — এবং শুদ্ধ বাংলা ছেড়ে তিনি চাষাঢ়ে চলিত ভাষায় কাব্য লেখা শুরু করেছেন, এইরকম অভিযোগও তাঁর জীবিত থাকা কালে তাঁর কাব্য সমালোচনা করতে গিয়ে করেছেন কেউ কেউ। একমাত্র সময়ই জানে, — কি চরম দুঃখ দূর্দশার মধ্য দিয়ে নিজের জীবনটা আশি বছরের দিকে নিয়ে গেছেন এই কর্মযোগী মানুষটি!
রবীন্দ্রনাথ ধনাঢ্য পিরালি ব্রাক্ষণ পরিবারে জন্মান। নাথ রবীন্দ্রনাথের একটি সারনেম। নাথ মুলত; ব্রাক্ষণ নন। গীতায় আছে, মানুষ দুই ভাবে ব্রাক্ষণ হন, —জন্মগত ভাবে কেউ কেউ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, আর দ্বিতীয়ত যোগ সাধনা করে কেউ কেউ ব্রাহ্মণ্য লাভ করেন। এই যোগ সাধনা করে ব্রাক্ষণ হওয়া লোকদের বলা হতো নাথ। যুগী বা নাথেদের গোষ্ঠীর সারনেম পরে নাথ ব্রাহ্মণ হয়ে যায়। তা কলকাতার বড় বড় চক্কোত্তি ব্রাক্ষণ পরিবারের লোকেরা এই নাথ ব্রাহ্মণ পরিবারের সাথে কোনও বৈবাহিক সম্পর্ক করতে চাইতো না। তার উপরে রবীন্দ্রনাথের বাবা ছিলেন ব্রাক্ষ্ম। ইংরেজ আমলে ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে এসে একদল শিক্ষিত হিন্দু জাতপাতের বৈষম্য বাদ দিয়ে বেদ এবং উপনিষদে যে এক ঈশ্বরের কথা আছে সেই মতন পরম ব্রক্ষ্ম বা একেশ্বরে বিশ্বাস করা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই ব্রক্ষ্মবাদীদের একজন। তিনি বোলপুরে একটি ব্রক্ষ্মচর্য আশ্রমও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই আশ্রমকে ঘিরেই পরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন।
পিরেলি ব্রাহ্মণে ফিরে যাওয়া যাক। রবীন্দ্রনাথের পরিবার একেতো নাথ ব্রাহ্মণ, তায় আবার ব্রাক্ষ্ম! সুতরাং কলকাতার কোনো হিন্দু ব্রাক্ষণ বা অভিজাত পরিবার এই পরিবারের সাথে বিয়ে শাদী বা আত্মীয়তা করতে চাইতো না। রবীন্দ্রনাথদের ভাইদেরকে তাই যশোরের তাদের পরিবারের বা জমিদারি সেরেস্তার যে সব পিরেলী কর্মচারী ছিল, তাদের মেয়েদের নিয়ে গিয়ে বিয়ে করানো হল। সুতরাং, বলা যায় বাঙালি গোঁড়া অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় এই পরিবারটিকে অর্থ বিত্তের জন্য মর্যাদা দিলেও, সামাজিকভাবে ততটা সমাদরের চোখে দেখতো না।
বাংলাদেশের অনেক অনেক উচ্চ শিক্ষিত মানুষ অভিযোগ করেন, রবীন্দ্রনাথ যেহেতু জমিদার ছিলেন, সুতরাং তিনি শোষকের দলেই ছিলেন এবং সেই কারনেই তিনি বঙগ ভঙ্গের বিরোধিতা করেন।
রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে ইংরেজ নীলকরদের কাছ থেকে তের টাকা চৌদ্দ আনা দিয়ে শাহজাদপুরের জমিদারি কুঠিবাড়িটি কেনেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তার ব্যবসা বাড়ানোর অংশ হিসেবে এই জমিদারি কিনেছিলেন। কুষ্টিয়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ থেকে রাজশাহী নওগাঁ পর্যন্ত ছিল এই জমিদারির অংশ।
রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ সাল থেকে শিক্ষানবিশ হিসেবে এই জমিদারি সেরেস্তার তদারকি করা শুরু করেন। ১৮৯৫ সালে তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আনুষ্ঠানিক ভাবে পাওয়ার অব এটর্নি দিয়ে তাকে পুরোপুরি জমিদারির ভার দিয়ে দেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সাল পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পরিবার সহ শাহজাদপুর থেকেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ মানসী ও চিত্রা এই সময়ে লেখা। কিন্তু বড় যে কথা মানুষ খুব বেশি জানে না তা হল, রবীন্দ্রনাথ প্রথম বাংলা ছোটগল্পের স্বার্থক স্রষ্ঠা। এবং বাংলাদেশের এই জমিদারি করতে গিয়ে পথে ঘাটে ঘুরে ঘুরে তিনি যে সব সাধারণ মানুষদের সাথে মিশেছিলেন, সেই জীবন তাকে এইসব ছোটগল্প তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি উনষাটটি গল্প শাহজাদপুরে থেকে লেখেন।
অন্নদাশংকর রায় এবং কলকাতার অনেক গবেষক কলকাতায় বসে অভিযোগ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ বড় প্রজানিপীড়ক জমিদার ছিলেন। অনেকে অভিযোগ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ জমিদারি বাঁচাতেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সত্য হল,—- রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে জমিদারির তদারকি বাদ দিয়ে বোলপুরের আশ্রমে থাকা শুরু করেন। ১৯০২ সালে তাঁর স্ত্রী মারা যান। পরের বছর ১৯০৩ সালে তাঁর মেজ মেয়ে রেনুকা মারা যায়। এবং ১৯০৫ সালে তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ মারা যান। এই পাঁচ বছরে জীবনের তিনজন প্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মারা যাবার পর রাজনীতি করার শক্তি রবীন্দ্রনাথের কোথায় আর অবশিষ্ট ছিল তা তাঁর সমালোচকরাই ভাল জানেন।
১৯০৫ সালে নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্রনাথ একটি কৃষিব্যাংক স্থাপন করেন। তিনি শাহজাদপুরে কুটির এবং হস্তশিল্প তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। একজন মুসলমান এবং একজন হিন্দু প্রজাকে শান্তিনিকেতনে পাঠানোও হয়েছিল হস্তশিল্প তাঁত এবং মাটির কাজ শেখানোর জন্য। ১৯০৬ সালে এই জমিদারির অর্থে তিনি বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথকে লন্ডনে পাঠান কৃষি ও পশুপালনের উপর পড়াশোনা করতে। ১৯০৭ সালে তিনি তার জামাতা শরৎচন্দ্রকেও কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য লন্ডন পাঠান। কিন্তু এদের পড়াশোনা তাঁর বিশেষ কাজে লাগেনি।
১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে শক্ত আঘাত পান, তাঁর ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ যে তার মা মারা যাবার সময় মাত্র নয় বছরের ছেলে ছিল, যে রাতে আলাদা খাটে শুয়ে বাবার হাত ধরে ধরে ঘুমাতো, সে মাত্র তের বছরে মারা যায়। শমীন্দ্রর মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে জীবন আর জগতের মধ্যে মৃত্যুর উপস্থিতি কেবল শরীর শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এই সত্য শিখিয়ে যায়,
— সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে,
চাঁদের আলোর দেশে গেছে।
যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে।
মনে হল আঁখির কোনে আমায় যেন ডেকে গেছে সে।
আমি কোথায় যাবো! কোথায় যাব।
ভাবতেছি তাই একলা বসে…….
এই গান শমীন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজের সমস্ত টাকা রবীন্দ্রনাথ পতিসরের সেই কৃষি ব্যাংকে রাখেন। উল্লেখ্য, ব্যাংকের তখন দূর্দিন চলছিল। কিন্তু সেই অবস্থার আর উন্নতি হয়নি এবং রবীন্দ্রনাথ সেই প্রাইজ মানির এক টাকাও আর ফেরত পান নাই। বহুবছর পর শান্তিনিকেতন থেকে বাঙাল রবীন্দ্রনাথের নোবেলটিও চুরি করে নেয়।
১৯১৬ সালে এক ম্যাজিষ্ট্রেট সরকারি রিপোর্টে বলেন, — জমিদার মাত্রই প্রজা নিপীড়ক হয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার ব্যাতিক্রম”…..
১৯১৮ সালে রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে বেলা মারা যায়। জামাই শরদিন্দুকে অনেক টাকা পণ দিয়ে এবং বিদেশে পড়ার খরচ দিয়ে পড়িয়ে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সাথে তার বনিবনা হল না। জামাই মেয়ে কলকাতায় আলাদা বাসায় থাকতো। রবীন্দ্রনাথ রোজ গিয়ে অসুস্থ মেয়েকে দেখে আসতেন। একদিন যাবার পথে শুনলেন তাঁর অতি আদরের মেয়ে বেলা মারা গেছে। তিনি পথ থেকে ফিরে চলে এলেন। বাড়ি ফিরে সবার সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বললেন, যেন জগতের কোথাও তেমন কিছু ঘটেনি, সব ঠিক ঠাক আছে……….
রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর মতো আদর্শে বিশ্বাস করতেন, তিনি ভাবতেন, বিশেষত রাজনীতি আর শিক্ষার ব্যাপারে ভারতীয়দের তখনো ইংরেজদের কাছ থেকে শেখার বাকি আছে। এজন্য তিনি স্বদেশী বিদ্রোহ পছন্দ করতেন না।১৯১৫ সালে ইংরেজ সরকার খুশি হয়ে তাকে নাইটহুড উপাধি দেয়। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ সেই নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। এরপর গান্ধীর সাথে তার রাজনৈতিক মতদ্বৈধতাও হয়েছে।
—–যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে……”. তার রাজনৈতিক আদর্শের গান।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন মারা যান, তার আগে তাঁর একমাত্র নাতি মারা গেছে। কি কারণে যেন তাঁর একমাত্র জীবিত পুত্র রথীন্দ্রনাথ কবির মুখাগ্নি করেননি। তাঁর এক নাতনি শ্মশানের এই শেষকৃত্য করেন। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের আর কোনও সরাসরি উত্তরসূরী নেই।
আপনারা যারা রবীন্দ্রনাথকে ঘৃণা করেন, সামন্তবাদী ভাবেন, তারা একলা নন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তিনি তাঁর সমালোচনা করা এই সব মানুষদের দেখে গেছেন। অন্নদাশঙ্কর আবুল মকসুদেরা তো সব সময়ই ছিল। লোকটা হিন্দুর জাতপাত মানতো না, — লোকটা গরীব মুসলমান প্রজা শোষণ করেছিল এমন সব অভিযোগকারীই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশাতেও দেখেছেন। কিন্তু তারপরও তিনি নিজে কন্দর্পক শুন্য হয়ে শান্তিনিকেতন আর বিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন। তার বাসভবন এবং স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে তিনি বিশ্বভারতী তৈরির চেষ্টা করেন।
প্রসঙ্গঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে এক জনসভা হয়। অনেকেই অভিযোগ করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেই সময় ওই জনসভায় ছিলেন। ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ রবীন্দ্রনাথ বিলেতে যাবার জন্য জাহাজের টিকেট কেটেছিলেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসেন এবং এরপর ২৪ মার্চ শিলাইদহ চলে যান। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ তিনি শিলাইদহতেই ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের লেখা বিশ্লেষণ করে এটি উদ্ধার করেন, — কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশিরভাগ লেখার নীচেয় তারিখ এবং স্থানের নোট রাখতেন। তাঁর চিঠিপত্র এবং লেখা থেকে দেখা যায় ১৯১২ সালের ২৪ মার্চ থেকে অন্তত ১২ই এপ্রিল পর্যন্ত তিনি শিলাইদহতেই ছিলেন। কাজেই গড়ের মাঠের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী জনসভায় যোগ দেননি তিনি। কিন্তু ২০০০ সালে এম এ মতিন তার লেখা একটি বইয়ে স্পষ্ট সেই অভিযোগ করেছেন। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানায় এবং তিনি খুব আনন্দিত মনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, মুসলিম হলে গিয়ে ছাত্রদের সম্বর্ধনা গ্রহণ করেন। কার্জন হলে বক্তৃতা করেন।
সমালোচকেরা সব সময়ই পন্ডিত হন।
আপনারা যারা রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করেন, তারাও সবাই পন্ডিতই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মোটে একজনই হয়।
সাজু বিশ্বাসের ফেসবুক ওয়াল থেকে।
লেখক ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী,
প্রিন্সিপাল অফিসার, সোনালী ব্যাংক লি.