হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। বিমানবন্দরের প্রধান ফটকের প্রবেশমুখে দেখা গেল বিদেশগামীদের লম্বা লাইন। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর দেখা যায় আরেক দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে অপেক্ষা করছে। এক সময় তাদের একজনের কাছে জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানায় দুবাই যাচ্ছে। তবে তাদের হাতে বড় কোন ব্যাগ দেখা যায়নি।
কিছুক্ষন পর তাদের সঙ্গে যোগ দিল আরও কিছু বিদেশগামী। তাদের কথাবার্তায় খেয়াল করে বুঝা গেল, তারা পূর্ব পরিচিত। একসময় তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় কি ভিসায় দুবাই যাওয়া হচ্ছে। প্রথমে কেউ না বলতে চাইললেও পরে তাদের একজন বলল ভিজিট ভিসায় যাচ্ছেন তারা।
কেমন খরচ পড়ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে আসা সোহেল নামে এক যুবক জানান, প্রাথমিকভাবে বিমান ভাড়াসহ তাঁর ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। চট্রগ্রামের একটি কলেজে পড়ুয়া এই ছাত্র জানান, তাঁর দুবাইয়ের একজনের সঙ্গে সাড়ে চার লাখ টাকার চুক্তি হয়েছে। দুবাই পৌঁছানোর পর সেখানে তাঁর কাজের ব্যবস্থা করে দিবেন তিনি।
অপর দিকে তাঁর সঙ্গে থাকা নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার আমজাদ হোসেন বলেন, “দুবাই থাকা এক বাংলাদেশির সাথে কন্ট্রাক্ট করেছি সে বলেছে কাজের ভিসা করে দেওয়া সহ সব মিলিয়ে চার লাখ টাকা খরচ হবে।“ এ পর্যন্ত তাঁর ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দুবাইয়ের ভিজিট ভিসায় গিয়ে কাজ করার কোন নিয়ম নেই ,তাহলে কিভাবে কাজ করবেন, এমন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দুবাইয়ে যার লোক আছে তাঁর কোন ঝামেলা নাই”।
এদিকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামছে তাদের সঙ্গে কথা চলছে, এসময় কিশোরগঞ্জের রাকিব মিয়া নামে একজন তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো- কাজ করতে বিদেশ যাচ্ছেন, বিএমইটির স্মার্ট কার্ড আছে কিনা। তিনি জানালেন কোন কার্ডের দরকার নেই বলে তাদের বলা হয়েছে।
রাকিবের কাছে জানতে চাওয়া হলো ভিজিট ভিসায় দুবাই গেলে একটা সময় পর সেখান থেকে চলে আসতে হবে, তখন তিনি জানান, “আমার ফুফাতো ভাই আছে সেখানে, তিনি সব ব্যবস্থা করবেন। দুবাই যাচ্ছি কাজের জন্য ফিরে আসার জন্য না”।
এবার তাদের কাছে জানতে চাওয়া হলো দুবাই বিমানবন্দরে কোন সমস্যা হবে কিনা? একজন জানালেন তাদের এজেন্সি থেকে সব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বিমানবন্দর থেকে তারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যাবেন। একটি গ্রুপে পাঁচ জন করে লোক থাকবে। তারা বিমানে উঠার আগেই সেই গ্রুপের একটি সেলফি তুলে দুবাই পাঠিয়ে দেবেন, সেখানে তাদের রিসিভ করার জন্য লোক থাকবে।
দুবাই বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কার কাছে যাবেন, কয়দিন থাকবেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে হাতে থাকা একটি সামনে এগিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের সবার হাতে এমন একটি করে কাগজ আছে সেখানে আমরা যার কাছে যাবো তাঁর নাম, ঠিকানা, পেশা লেখা আছে এগুলো আমাদের মুখস্থ করতে বলা হয়েছে। যাতে দুবাই বিমানবন্দরে ভালো করে বলতে পারি। তাহলেই আর কোন সমস্যা হবেনা”।
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ ভিজিট ভিসায় কড়াকড়ি আরোপ করলেও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল মধ্যপ্রাচের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে এ সুযোগের অপব্যবহার করে কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ভিজিট ভিসায় কর্মী পাঠাচ্ছে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সিসহ অসাধু চক্র।
এদিকে ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশীদের যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাংলাদেশ দূতাবাসও। সম্প্রতি দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বর্তমানে ভিজিট ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে ‘ওয়ার্ক ভিসায়’ পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তাই চাকরি বা কাজের উদ্দেশ্যে ভিজিট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমিরাতে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছে দূতাবাস। এ বিষয়ে কোনো রিক্রুটিং এজেন্ট বা দালালের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ না হওয়ার জন্য সবাইকে সতর্কও করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্রাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান প্রবাস বার্তাকে বলেন, “ভিজিট ভিসা কখনোই কাজের নিশ্চয়তা দেয়না। আমাদের জন্য সেসব দেশে ভ্রমণ ভিসা থাকে, যেখানে বেড়াতে যাওয়া যায়, কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় সেখানে আমাদের দেশ থেকে কাজের জন্য লোক যাচ্ছে। এখনকার যুগ হচ্ছে ডিজিটাল। একজন মানুষ যেই দেশেই যাচ্ছে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে তাকে সে দেশে প্রবেশ করতে হচ্ছে। কোথাও বেড়াতে গিয়ে কাজ করা কিন্তু আইনগতভাবে অবৈধ। যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে দুবাই যাচ্ছে, তাদের কিন্তু সংকটে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই অভিবাসন বিশ্লেষক আরও বলেন, যারা ভিজিট ভিসায় দুবাই যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই অবৈধ চক্রের প্রলোভনে পড়ে কিন্তু যাচ্ছে। এটি তাদের জন্য সুখকর হবেনা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা অথবা বাংলাদেশিদের সমঝোতার মাধ্যমে ভিজিট ভিসায় গিয়ে কাজের সুযোগ পাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত যেহেতু একটি বড় শ্রমবাজার তাই এভাবে ভিজিট ভিসায় না গিয়ে সেখানে যদি কাজের চাহিদা থাকে তাহলে সরকার তাদের বৈধভাবে পাঠানোর উদ্যোগ নিতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটিতে ২০০৮ সালে গিয়েছিলেন সর্বোচ্চ ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী। ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর টানা দুই লাখের বেশি করে কর্মী দেশটিতে যান। পরে হঠাৎ করেই নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ২০১২ সালের শেষ থেকে কর্মী নেয়া এক রকম বন্ধই করে দেয় আমিরাত।
সূত্রঃ প্রবাস বার্তা