গোলাম মোস্তফা:: কানাডা থেকে।
একজন মানুষকে মোটামুটিভাবে একজন সামাজিক মানুষ হতে হলে তার তিনটি মানবিক যোগ্যতার (Essential Human capacity) মধ্যে সুন্দর সমন্বয় থাকতে হয়। একজন মানুষের তিনটি মানবিক যোগ্যতা তাহলে কী?
সেগুলো হলো:
বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা (Cognitive)
আবেগীয় যোগ্যতা (Affective)
আচরনগত যোগ্যতা (Behavioural)
বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা হল মানুষের সেই যোগ্যতা যা মানুষ তার মস্তিস্ক দিয়ে নিজ ও অন্যের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তা বিচার বিশ্লেষন করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে । মানুষের বুদ্ধিৃবৃত্ত্বিক যোগ্যতা আবার দুধরনের: তাদের একটিকে বলা হয় স্কীমা(Schema)-যা দ্বারা মানুষ অন্য মানুষ বা বিষয় সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে একটি ধারনা পোষন করে ফেলে বা তা ব্যাখ্যা করে বসে। যেমন ইটালিয়ানরা খুব রোমান্টিক। এখানে খুব কম তথ্যের ওপর নির্ভর করে সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছে।
মানুষের সামাজিক বুদ্ধিৃবৃত্তিক যোগ্যতার আরেকটি দিক হচ্ছে মনোভাব(Attitude): এটি দ্বারা একজন মানুষ আরেকজন মানুষ বা গোষ্ঠী সম্পর্কে ভাল বা খারাপ ধারনা পোষন করে। যেমন, মুসলমানরা মাত্রই সন্ত্রাসী, পশ্চিমারা খুব সভ্য।
এখানে একজন মানুষ তার মস্তিস্কে ‘মুসলমান’ এবং ‘পশ্চিমা’দের ওপর যে তথ্য সংগ্রহ করেছে তার ওপর ভিত্তি করেই তার মনোভাব তৈরী হয়েছে। এবং সেভাবেই মুসলমান ও পশ্চিমাদের ব্যাখা করেছে।
এই স্কিমা ও মনোভাবের কারনে একেক জন মানুষ কোন একটি ঘটনাকে একেকভাবে ব্যাখা করে। যেমন কেউ কেউ করোনা ভাইরাসকে বলছে পৃথিবীর মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য চীনাদের আবিস্কার। কেউ কেউ বলছে এটি আমেরিকার ষড়যন্ত্র। কেউ কেউ বলছে এ রোগ মুসলমানদের হবেনা। কারন তারা দিনে পাচবার অজু করে। কেউ কেউ বলছে এটি বাদুর থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ইত্যাদি।
এভাবে মানুষের সামাজিক বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা ভিন্নতর হওয়ার কারনেই সমাজে এত ভিন্নমত, এত হিংসা আর হানাহানি।
মানবিক যোগ্যতার আরেকটি গুরুত্বপুর্ন দিক হচ্ছে আবেগীয় যোগ্যতা (Affecttive)। মানুষের অনুভুতির প্রকাশ পায় এটি দ্বারা। ভালবাসা, রাগ, ভয় ও ঘৃনা মানুষের আবেগীয় যোগ্যতার উদাহরন।
মানুষের মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে তার আবেগ কেমন হবে। আবার মানসিক অবস্থা নির্ভর করে মুডের ওপর। মুড ভাল থাকলে ভালবাসা, স্নেহ, মায়া মমতা তৈরী হয়। আর মুড ভাল না থাকলে রাগ, ঘৃনা, ভয় তৈরী হয়।
মানুষের মুড নির্ভর করে আবার তার শারীরিক স্বাস্থ্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর। শরীর ভালতো মন ভাল। চারিদিকে শব্দ, চেচমেচি, মারামারি, ঝগড়া বিবাদ মানুষের মুড/মনকে নষ্ট করে দেয়। সে জন্য ভাল শারীরিক স্বাস্থ্য ও ভাল পরিবেশ সামাজিক সুসম্পর্ক তৈরীতে সহায়তা করে। মানুষ তখন ভাল আচরনও করে।
মানুষের সামাজিক আচরনগত যোগ্যতার একটি বড় কম্পোনেন্ট হল পরস্পরকে সহযোগীতা করার বিষয় (Reciprocal Altriuism)। একজন মানুষ অসুস্থ্য হলে আরেকজন মানুষ সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদানে অসুস্থ্য লোকটি সুস্থ্য হয়ে সাহায্যকারী লোকটিকে আবার সাহায্য করে। এটিই সামাজিক নিয়ম বা আচরন। কিন্তুু একজন মানুষ শুধু নিতেই থাকবে কিন্তুু তার বিনিময়ে কিছু দিবেনা তাহলে সে সমাজে চিটার শ্রেনীর মানুষ বেড়ে যায় এবং সমাজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
ব্যক্তিগত জীবনে একজন মানুষ যদি ভালবাসা, স্নেহ, মায়ামমতা না পায় সামাজিক জীবনে সে শুধু সেগুলো পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, কিন্তুু সে কাউকে কখনো কিছু দিতে চায়না। অর্থাৎ তার সামাজিক আচরনে মারাত্বক ঘাটতি দেখা যায় যা সমাজের জন্য খুব ক্ষতিকর। এ ধরনের মানুষ সমাজ বা দেশের গুরুত্বপুর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহনের জায়গায় থাকলে দেশের দুস্থ্য ও দুর্বল মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকারক হয়। কারন এধরনের মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় নিষ্ঠুর ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। যেমন কোন মহামারীর সময়েও নেতানেত্রীদের দ্বারা গরীর মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত রিলিফের পণ্যসামগ্রী চুরির সিদ্ধান্ত নেয়া এগুলোর উদাহরণ।
স্কুলের কারিকুলামে প্রত্যেক শিশুর ভারসাম্যপুর্ণ উন্নয়নের জন্য মানব যোগ্যতার উপরিউক্ত তিনটি ক্যাপাসিটির ওপর সমান গুরুত্ব দিতে হয়। এ ধরনের ভারসাম্যপুর্ণ কারিকুলাম থাকলে শিশুরা পাঠ্যপুস্তক থেকে নানা তথ্যউপাত্ত জানার সাথে সাথে নানান ধরনের কসরতের মাধ্যমে শরীর গঠন থাকে যা তার মানসিক বা আবেগীয় বুদ্ধিমত্ত্বাকে বাড়িয়ে দেয়।অন্যান্যদের সাথে কিভাবে মিশতে হয় তার দক্ষতা অর্জন করতে পারে। সেই সাথে স্কুলে, পরিবারে, সমাজে সহযোগীতামূলক আচরণ কিভাবে করতে হয় তাও শিখে থাকে। এভাবে বেড়ে ওঠা একটি শিশু বড় হয়ে সমাজে একজন ভাল নাগরিক হয়। সাথে সাথে একজন ভাল নেতাও হয়।
পরিশেষে বলা যায়, একজন মানুষকে মোটামুটিভাবে একজন পরিপুর্ন সামাজিক মানুষ হতে হলে মানবিক যোগ্যতার তিনটি বিভাগের (বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগীয় ও আচরনগত) মধ্যে একটি ভারসাম্যপুর্ন অবস্থান রক্ষা করা জরুরী। নেতৃত্ব পর্যায়ে যারা থাকেন তাঁদের মধ্যে এ তিনটি গুন থাকা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। নইলে স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী নেতৃত্ব সমাজে গেড়ে বসে।
লেখক:: Director, Bengali information and Employment Service (BIES), Canada