পশ্চিমা ঔষধ এবং জনস্বাস্থ্যের রাজনীতি

নিউজ ডেস্ক | রাজবাড়ী টেলিগ্রাফ / ৪১৮ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ আপডেট : সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০২০

0Shares

মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন।।

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাঁর একটি প্রবন্ধে (The Condition of the Working Class in England) প্রশ্ন তুলেছিলেন হত্যাকারী কে? কে অপরাধটা সংঘটিত করলো? কেনই বা করলো? তবে হত্যাকারীকে দেখা যায়না। নিহত ব্যাক্তিকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় প্রাকৃতিকভাবেই তিনি মৃত্যূবরণ করেছেন। অপরাধটা সংঘটিত হচ্ছে যতটা না দালালি থেকে তার চেয়েও বেশি হচ্ছে ভ্রান্তি থেকে। এঙ্গেলস ব্যাখ্যা করেন ইংল্যান্ডের ওয়ার্কিং ক্লাস প্রতি ঘন্টায়, প্রতিদিনে যে হারে মৃত্যূবরণ করছেন এটি একটি সামাজিক হত্যাকান্ড (Social Murder) । মানুষ মৃত্যূবরণ করবে এটাই স্বাভাবিক তবে সমাজ বা রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনায় যে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে তাতে ব্যক্তি স্বাস্থ্য হারাচ্ছে এবং অপ্রাকৃতিক মৃত্যূ (Unnatural Death) বরণ করছে। লন্ডন শহর সঠিক মাত্রার অক্সিজেন পায়না, এই শহরের আড়াই মিলিয়ন লাঙ্ক অক্সিজেন সংকটে ভুগে, ভেন্টিলেটরহীন চার বর্গমাইলের একটি শহর, বিল্ডিং তৈরির ব্যবস্থাপনা এই শহরকে ভেন্টিলেটরহীন করে দিয়েছে। এঙ্গেলস ঊনিশ শতকের লন্ডন শহরকে তাঁর লেখায় এইভাবেই তুলে ধরেছেন।

বর্তমানে লন্ডনে বাংলাদেশের যারা বসবাস করেন তারা দেশে ফিরে এসে খুব উৎসাহের সাথেই বলেন লন্ডন শহর ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের দখলে। বৃটিশরা শহরে থাকেননা, তারা শহরে এসে কাজ করে চলে যায়। তাদের অধিকাংশের বাসা শহরের বাহিরে। ইংলিশরা কার্ল মাক্স এবং এঙ্গেলসদের মতামতকে গ্রহণ না করলেও তাদের সমালোচনা গুলোকে গ্রহণ করেছে। বস্তুবাদী পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনে কম্প্রোমাইজ করেছেন। বর্তমান বৃটিশ রাণি এলিজাবেথ জনসম্মুখে আসলে সবসময় হাতে গ্লাভস পরে থাকেন, বিষয়টি আমরা সকলেই খেয়াল করেছি। প্রতি জোড়া গ্লাভসের দাম প্রায় ১৪০ ইউ এস ডলার। একবার কয়েক ঘন্টা পরেই তা ফেলে দেয়া হয়। তিনি কেন গ্লাভস পরেন? গুগল করে দেখে নিতে পারেন। সৌদি বাদশা করোনা থেকে বাঁচতে রাজ প্রাসাদ ছেড়ে দিয়ে দ্বীপে চলে গেছেন। বিষয়টি নিশ্চয় আমরা খেয়াল করেছি। পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ নিজের উইলে চলার স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই বিষয়গুলোকে না বুঝে ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা ঠিক হবেনা। সার্বক্ষনিক করোনা এক্সপোজার থেকে, ফ্রন্ট লাইনে কাজ করে, না খেয়ে, দু:খ-কষ্টে ভুগে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচা আর আক্রান্ত হলে হার্ড ইমিউনিটি দিয়ে মোকাবেলা করা বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়। এখানেই জনস্বাস্থ্যের রাজনীতির কার্যকারিতা। এঙ্গেল তাঁর পুরো লেখায় তাই বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। পলিটিকাল ইকোনোমি যদি ফাংশন করে তাহলে যে মানুষদের জন্য পলিটিকাল ইকোনোমি তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পলিটিক্স অফ পাবলিক হেলথও ফাংশন করতে হবে, নচেৎ মহামারী নিয়ন্ত্রন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর জনস্বাস্থ্য নিয়ে কার্যকরী পরিকল্পনা থাকবে এবং জনগণ পরিকল্পনা দেখে বিবেচনা করবেন। আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেতার পরও উইনস্টোন চার্চিল ইংল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনে হেরে গিয়েছেন। ক্লিম্যান্ট এ্যাটলী তার নির্বাচনী প্রচারণায় জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা (National Health Service) প্রতিষ্ঠাকে প্রধান বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন । যেখানে তিনি একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের অঙ্গিকার করেছেন। সত্যি এ্যাটলী ইংল্যান্ডে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের সূচনা করেছিলেন। অর্থ উপার্জন নয়, রাষ্ট্রের ঔষধ নয়, জনস্বার্থে জনস্বাস্থ্যকে সংস্কার করা এবং তা বজায় রাখার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বাস্তবায়নকে এখানে পলিটিক্স অফ পাবলিক হেলথ বলা হচ্ছে। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা প্রয়োজন, সুযোগ পেলে পরে আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।

পশ্চিমা ঔষধ যাত্রা শুরু করেছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে। ঊনিশ ও বিশ শতকে এই ঔষধের উত্থান হয়েছে। ভ্যাকসিন আর এন্টিবায়োটিকের আবিস্কার পশ্চিমা ঔষধ উত্থানের মাইল ফলক। আঠার শতক পর্যন্ত পশ্চিমা ঔষধ আমাদের মতোই ট্রায়াল এ্যান্ড এরোরের মধ্য দিয়ে ডেভেলপ করেছে। আঠারো শতক পর্যন্ত পশ্চিমা ডাক্তারগণ টিবি রোগের চিকিৎসা হিসেবে রোগীর শরীরের সব রক্ত বের করে ফেলতেন। শুনে আজব লাগছেনা? বাতাসকে রোগের কারণ মনে করতেন। আরো কতো কী। এগুলো নিয়ে এক সময় আলোচনা করা যাবে। আঠারো শতক পর্যন্ত পশ্চিমাদের চিকিৎসা আর ভারতবর্ষের চিকিৎসা বিশ্লেষণ করলে ভারতবর্ষের চিকিৎসাকে আমাদের কাছে অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত মনে হবে। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন ভারতবর্ষের চিকিৎসা আধুনিকতার সাথে খাপ খাওয়ানো যাবে কিনা? এক সময় যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত ছিল এখন নাই কেন, আমি সেই প্রশ্নই করতে চাই। ডেভিড আরনল্ড তার বইয়ের নাম দিয়েছেন কলোনাইজিং দ্যা বডি, এই বইয়ের নামের মধ্যেই রয়েছে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব। পশ্চিমারা পুঁজিবাদের সম্প্রসারণের সাথে সাথে পুঁজিকেন্দ্রিক ঔষধেরও সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমরা ভুলেই গিয়েছি এগুলো পশ্চিমা ঔষধ।

পশ্চিমা ঔষধ নিয়ে আমার কোনো বিদ্বেষ নাই। পৃথিবীর যে কেউ ঔষধ আবিস্কার করলে বিশ্বের মানুষ হিসেবে আমিও সে ঔষধ পাওয়ার দাবীদার। কিন্তু এই ঔষধ প্রদান করা হয় অর্থের মানদন্ডে। চিকিৎসা পাওয়ার জন্য আমাকে বীমা করতে হয়। সিকো মুভিতে নিশ্চয় দেখেছেন, একজন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নাগরিক এ্যাকসিডেন্টের পর নিজের শরীর নিজে সেলাই করছেন। আরেকটি প্রশ্ন অতীব জরুরী- আমার আপনার কেন এত পরিমাণ ঔষধ লাগবে? কেন আমাদের দাদাদের কিংবা দাদার বাবাদের জীবন চলার জন্য এত পরিমাণে ঔষধ লাগেনি। কেন আজ খাবারের খরচের চাইতে চিকিৎসা খরচ বেশি? প্রশ্ন করতে হবে, হয়তো এক সময় এর উত্তর মিলবে, আর তখনই উত্তর মিলবে কেন জীবানু অস্ত্র নিয়ে প্রতিযোগিতা আর কেন আমরা আমাদের ইতিহাস ভুলে গেছি।

( লেখক, মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)

Facebook Comments


এ জাতীয় আরো খবর
NayaTest.jpg