সাজু বিশ্বাস।।
একটা শব্দের কয়েকরকম অর্থ হয়। যেমন, অলকা শব্দের তিনটে অর্থ। অলোকা মানে কুবেরের বাড়ি— অলোকা মানে ছয় থেকে দশ বছরের বালিকা মেয়ে। আবার অলোকা মানে সাদা আকন্দ ফুল। মানে তিনটে একেবারেই আলাদা আলাদা অর্থ বুঝাতে অলোকা শব্দটি ব্যবহার করা যাবে।
মা-য়ি হে,
কলঙ্কিনী রাধা…..
কদম ডালে বসিয়া আছে, কানু হারামজাদা
মা হে তুই জলে না যাইও……..||
এখন ওয়েব সিরিজের জামানা।
ভারতে বুলবুল নামের একটি ওয়েব সিরিজ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে গত চব্বিশ জুন। সেখানে আমাদের দেশের রাধারমণ দত্তের কানু হারামজাদা গানটাকে ব্যবহার করা হয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা অভিযোগ দিয়েছেন, গানটিতে রাধা এবং কৃষ্ণকে অশ্লীল ভাষায় সম্বোধন করা হয়েছে।
কানু হারামজাদা গানটি কিন্তু দুই বাংলাতেই কয়েক বছর ধরে বেশ জনপ্রিয় ফিউশন। অনেকেই গেয়েছেন। অনেক বাউল মুখে মুখে গেয়ে ফিরছেন গানটি। কিন্তু অনেকেই জানেননা গানটির আসল লেখক কে! এমনকি নেটফ্লিক্সের অভিযোগে অনেকে লিখেছেন এটি বাংলাদেশের বাউল শাহ আব্দুল করিমের লেখা গান।
কি বড় সাহস! আব্দুল করিম শাহ্ মোছলমানের ছেলে হয়ে গানে কৃষ্ণকে কানু হারামজাদা বলেন! এটাই ছিল বোধহয় গানের দিকে তাক করে ছোঁড়া প্রথম সন্দেহের তীর! এদিকে আব্দুল করিমের এরকমই রাধা- ভাবের আরো অনেক গান আছে, —
আমি কুল হারা কলঙ্কিনী….
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী।
এইসব গানের জন্য মুসলমান সমাজ থেকেও তাকে একদিন ভিটে ছাড়া করেছিল। মুসলমানের ছেলে হয়ে তুমি রাধা তত্ত্ব নিয়ে গান লেখো আর তাই গাও!!
বেচারা আব্দুল করিম! এইবার কিন্তু বিনাদোষে, না গেয়ে নেটফ্লিক্সের রোষে পড়ে গেলেন।
মুলতঃ কানু হারামজাদা, বা কলঙ্কিনী রাধা নতুন কিছুও নয়, দোষের কিছুও নয়। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি আর লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেবের গীত গোবিন্দ দিয়ে রাধা- কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। তাও বিদ্যাপতি আর জয়দেবের কয়েকশো বছর পর বাঙালির প্রেমিক সাধক নিমাই সন্যাসী বিদ্যাপতি জয়দেব পড়তে গিয়ে রাধা- প্রেমে মজে যাবার পর তিনি যখন রাধা-প্রেমকেই সাধনার বিষয়বস্তু করে বিভোর হয়ে যান, তারপর থেকে তাঁর মানে গৌরাঙ্গের অনুসারীরা সাধনার অংশ হিসেবে রাধাকৃষ্ণ নিয়ে গান, জীবনী দোহা কীর্তন এবং ছন্দ লেখা শুরু করেন। এগুলির নামই পরবর্তীকালে বৈষ্ণব সাহিত্য হয়। শেষমেশ দেখা যায়, সতেরো ও আঠারো শতক জুড়ে প্রায় দুশো বছর ধরে এই বৈষ্ণব সাহিত্য চর্চা হয় যার মুল বিষয়বস্তু রাধা-কৃষ্ণের প্রেম।
আমাদের দেশের বৈষ্ণব বাউল রাধারমণ দত্ত মুলত; সেই বৈষ্ণব সাহিত্য চর্চাকেই উনিশ শতকে টেনে নিয়ে এসেছিলেন। রাধারমণের বাবা রাধামাধব দত্ত জয়দেবের গীত গোবিন্দ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। কাজেই রাধা কাহিনী চর্চা ছিল রাধারমণের পারিবারিক ঐতিহ্য এবং বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যের ধারাবাহিকতা।
আমাদের শাহ্ আব্দুল করিমের জন্ম মুসলমানের ঘরে সত্যি কথা, কিন্তু শাহ্ আব্দুল করিমই রাধারমনের পরবর্তী উত্তরসূরী। এবং বৈষ্ণব সাহিত্যকে ধারাবাহিক ভাবে বিংশ শতাব্দীতে টেনে নিয়ে আসা একমাত্র মানুষটির নাম শাহ আব্দুল করিম। তা সে বৈষ্ণবরা এই সত্য স্বীকার করুক বা না করুক তাতে কিচ্ছু আসে যায়না। কিন্তু এটাই সত্যি।
শাহ্ আব্দুল করিম এখন পর্যন্ত বৈষ্ণব সাহিত্য এবং রাধা- প্রেমের শেষ ধারাবাহিক উত্তরসূরী।
এইবার গালাগালির কথায় আসি।
শ্রীকৃষ্ণকে গালাগালি করার ব্যাপারটা বৈষ্ণব সাহিত্য থেকেই শুরু হয়েছে। মহাভারতের কৃষ্ণ একজন মোটামুটি ব্যালেন্স ক্যারেক্টার। তিনি তুখোড় রাজনীতিবিদ এবং দার্শনিক বেশি, তুলনায় প্রেমিক কম। একমাত্র রুক্মিণীরে প্রেম করে বিয়ের আসর থেকে তুলে আনা ছাড়া সেই শ্রীকৃষ্ণের সাথে আর খুব একটা প্রেমের লেনদেন নেই। এবং মহাভারতে রাধা বলে কোনো চরিত্রও নেই।
পরবর্তীকালে ভগবত পুরাণ তৈরি হয়। এবং সেইখানে রাধা চরিত্র কৃষ্ণের পাশে চলে আসে। ননীচোরা, নটঘট, রমনীমোহন, গোপীজনের হৃদয়হরণ এইসব বড় বড় বিশেষণ কৃষ্ণর নামের পাশে যুক্ত করে এই বৈষ্ণব ওস্তাদেরা। সাথে সাথে রাধা এবং লীলার ব্যাপারটিও। এবং সেই উপলক্ষে রাধা কলঙ্কিত।
গালাগালির ব্যাপারটি নতুন কিছু নয়। সাহিত্য এবং বৈষ্ণব সাধনার বিষয়টিকে অনেক বেশি নিকটতম করে তোলার জন্য কৃষ্ণকে সাধারণ মানুষদের মত প্রেম ভালবাসা বিরহ এইসব ঘটনার অংশ হিসেবে দেখাতে যেয়ে তাকে হারামজাদা বলা হয়েছে। বাংলায় কিন্তু এটি তেমন গালাগালিই নয়। হারমজাদা শব্দে একটি ঘরের ছেলে ঘরের ছেলে ভাব আছে। এমনকি কলঙ্কিনী রাধা বৈষ্ণব সাহিত্যে একটি দুর্নামের নয়, বরং সম্মানের বিষয়।
তোরে বানাইয়া রাই বিনোদিনী,
আমি হইবো কালাচাঁন।
শ্যাম কলঙ্কের জ্বালা কতরে…
আমি করব আজ তার প্রমাণ || রাধারমণের গান।
কাজেই রাধার কলঙ্কও সাহিত্য এবং বৈষ্ণব ভাব সাধনায় বেশ সম্মানের বিষয়। রাধা হল কৃষ্ণ প্রেমের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নমুনা, যে কলঙ্কিত হয়েই কৃষ্ণর জন্য অপেক্ষা করে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। এটাই মুলতঃ বৈষ্ণব সাধনার বিষয়বস্তু।
কাজেই হারামজাদা বা কলঙ্কিনী রাধায় দোষ হয় নাই। প্রথম দোষ হইছে শব্দের অর্থ অনুবাদ নিয়ে। যে কৃষ্ণরে ঘরের ছেলে বানানোর জন্য কানু হারামজাদা বলা হইছে, ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে সেই হারামজাদা শব্দকে বলা হইছে বাস্টার্ড। — বেজন্মা!
কলঙ্কিনী রাধা বৈষ্ণবরা ব্যবহার করেন রাধার পবিত্র প্রেম বুঝানোর জন্য। নেটফ্লিক্সে কলঙ্কিনীর ইংরেজি শব্দার্থ হিসেবে ব্যবহার করা হইছে লজ্জাহীনা নারী।শেইমলেস মহিলা!
এদিকে সবাই ভেবে নিয়েছে গানটি আব্দুল করিম মুসলমানের ঘরের ছেলের লেখা!
আর যায় কোথায়! বাজার পুরোই কানু হারামজাদা আর কলঙ্কিনী রাধা নিয়ে গরম।
শেষ কথা, ওহে! একটা শব্দের আটটা অর্থ হয়।
অনুবাদ করার সময় একটু দেখেশুনে করিও পিলিগ!
বাংলার আদুরে হারামজাদা আর ইংরেজির বাস্টার্ড এক নয়। বাংলার শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলের রাধারে ইংরেজিতে শেইমলেস ওম্যান বানায়া দিলে গ্যাঞ্জাম তো পাকবেই!
( লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, বর্তমানে প্রিন্সিপাল অফিসার, সোনালী ব্যাংক লিঃ খুলনা)