হলুদ সাংবাদিকতা কী, এর উৎপত্তি ও ইতিহাস

সম্পাদকীয় | রাজবাড়ী টেলিগ্রাফ / ২৭৮৬ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ আপডেট : শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

0Shares

পেশার কি কখনো কোন রং হয়? যদি বলি হয়! হ্যাঁ, পেশারও রং হতে পারে। কেন হলুদ সাংবাদিকতার কথা কি কখনো শোনেননি? তবে এই হলুদ সাংবাদিকতা কিন্তু কোন সাংবাদিকের জন্য মোটেও গর্বের কোন বিষয় নয় বরং এটি অনেক লজ্জার। বিভিন্ন সময়ে এই শব্দ যুগল বার বার একত্রে হাজির হয়ে জানান দিয়ে গেছে তার অস্তিত্বকে। তাই এর অর্থ সম্পর্কে আমাদের কম-বেশী সবারই ধারণা রয়েছে। কিন্তু কিভাবে এই শব্দ যুগলের একত্রে আবির্ভাব হয়, কেনই বা সংবাদপত্রের এই পরিভাষার উদ্ভব হলো বা এতো রং থাকতে হলুদকেই কেন বেছে নেওয়া হলো; এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আমার আজকের লেখা।

হলুদ সাংবাদিকতা কী :

উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনকেই হলুদ সাংবাদিকতা বলা হয়। এ ধরনের সাংবাদিকতায় ভাল মতো গবেষণা বা খোঁজ-খবর না করেই দৃষ্টিগ্রাহী ও নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হল সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে যেভাবেই হোক পত্রিকার কাটতি বাড়ানো বা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়ানো। অর্থাৎ হলুদ সাংবাদিকতা মানেই ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকৰ্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্ৰতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কেলেংকারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্ৰচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি ইত্যাদি।

শুরুর গল্প:

সাংবাদিকতায় জোসেফ পুলিৎজার এবং উইলিয়াম হিয়ার্টজের অবদান কম নয়। মজার ব্যাপার হলো, সাংবাদিকতায় যাদের এতো অবদান তাদের একরকম পাগলামির জন্যই সাংবাদিকতায় যুক্ত হয় ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা।

পুলিৎজারের জন্ম হাঙ্গেরীতে হলেও সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সুত্রে তিনি স্থায়ী হন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮৮৩ সালে সম্পদশালী ব্যক্তিরূপে পুলিৎজার ৩,৪৬,০০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে জে গোল্ডের কাছ থেকে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ক্রয় করেন। ঐ সময়ে পত্রিকাটি প্রতি বছর গড়ে চল্লিশ হাজার ডলার লোকসান দিতো। প্রচার সংখ্যা বাড়াতে পুলিৎজার মানবধর্মী কৌতুলহলোদ্দীপক গল্প, রটনা এবং আবেগধর্মী বিষয়াবলী অন্তর্ভূক্ত করেন। মূলত ১৮৮০ এর দশকে সাংবাদিকতার নতুন কলাকৌশল প্রবর্তন করে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে যান তিনি।
অন্যদিকে জন্মসূত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন হিয়ার্টজ। যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিলেন তিনি। ১৮৯৫ সালে মায়ের কাছ থেকে অর্থ নিয়েই তিনি নিউইয়র্ক জার্নাল পত্রিকাটির মালিকানা ক্রয় করেন। আর জড়িয়ে যান পুলিৎজারের সাথে এক ভয়ানক যুদ্ধে।

মূলত ১৮০০ শতকের শেষ দিকে নানা ধরণের পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু সমাজের সব শ্রেনির মানুষের কাছে তখনো পত্রিকা পৌছাতে পারেনি। তাই সংবাদপত্রগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকাশক এবং সম্পাদকেরা নানান ধরণের নতুন নতুন ধারণা নিয়ে আসতে চেষ্টা করেন।
জোসেফ পুলিৎজারও এর ব্যাতিক্রম ছিলেন না। তার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় কমিক স্ট্রিপ ছাপা হতো। অল্প সময়েই অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই কমিক স্ট্রিপের নাম ছিল ‘হোগান’স অ্যালি’ যার কার্তুনিস্ট ছিলেন রিচার্ড এফ. আউটকল্ট। এখানে সাম্প্রতিক বিষয়গুলোকেই স্যাট্যায়ার করে তুলে ধরা হতো।
কয়েকটি শিশুকে নিয়েই মূলত এই কমিক স্ট্রিপ। এই শিশুদের একজনের শরীরের রং ছিল ইয়েলো বা হলুদ। এই হলুদ বর্ণের শিশুই ছিল কমিক স্ট্রিপের মুল চরিত্র। নানা ধরণের ব্যঙ্গ কথা সে বলতো। শরীরের রং হলুদ হওয়ার কারনে তাকে ডাকা হতো ‘ইয়েলো কিড’ নামে। আর এই ইয়েলো কিডকে কেন্দ্র করেই পুলিৎজার এবং হিয়ার্টজের মধ্যে শুরু হয় এক ভয়ানক যুদ্ধ। যার ফলে সৃষ্টি হয় ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা। আর সাংবাদিকতার এই পরিভাষাটির নামকরণ করেন নিউইয়র্ক সানের সম্পাদক চার্লস এ. ডেনা।

হলুদ শিশু থেকে হলুদ সাংবাদিকতা:

পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড –এ প্রকাশিত কমিক স্ট্রিপটি পত্রিকার কাটতিও বেশ বাড়িয়ে দেয়। কার্টুনটি চার পাতা জুড়ে প্রকাশিত হতো। হিয়ার্টজ তখন চিন্তা করলেন এই কমিক স্ট্রিপ যদি তার পত্রিকাতেও ছাপানো যায় তাহলে তার পত্রিকার বিক্রিও অনেক বেড়ে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। হিয়ার্টজ চড়া মুল্যে ‘হোগ্যান’স অ্যালি’র কার্টুনিস্ট রিচার্ড এফ. আউটকল্টকে নিউইয়র্ক জার্নালে নিয়ে আসেন। এবার কার্টুন স্ট্রিপ নিউইয়র্ক জার্নালেই প্রকাশিত হতে শুরু করে। কিন্তু এতে দমে জাননি পুলিৎজার। তিনি কমিক স্ট্রিপটি তার পত্রিকায় আগের মতোই ছাপতে লাগলেন। আর এজন্য নিয়োগ দিলেন নতুন কার্টুনিস্ট জর্জ বি লাককে। অন্যদিকে হিয়ার্টজ নিউইয়র্ক জার্নালে ৮ পাতা জুড়ে প্রকাশ করতে লাগলেন কমিক স্ট্রিপ। শুরু হয়ে যায় দুই পত্রিকা এবং দুই মালিকের মধ্যে এক ভয়ানক প্রতিযোগিতা। তারা একে অন্যকে আক্রমণ করেও কার্টুন প্রকাশ করে যেতে লাগলেন।

দুটি পত্রিকাই জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে চাইছিল। তাদের প্রতিযোগিতা শুধু ‘ইয়েলো কিড’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। সব কিছু নিয়েই তারা প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পরতো। তাদের এই প্রতিযোগিতায় সংবাদের বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে পাঠক সংখ্যা; বাদ যায়নি কোন কিছুই। পুলিৎজার এবং হিয়ার্টজের মধ্যে দন্দ এতোটাই চরমে ওঠে যে তারা একে অন্যের কর্মচারী, রিপোর্টার বেশী টাকা বেতন দিয়ে নিজেদের পত্রিকায় নিয়ে আসতে শুরু করেন। এই ভয়ংকর প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য হিয়ার্টজ তার পত্রিকার মুল্য দুই সেন্ট থেকে এক পেনিতে নিয়ে আসেন। স্বাভাবিকভাবেই নিউইয়র্ক জার্নালের বিক্রি নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। পুলিৎজারও বাধ্য হন তার পত্রিকার মুল্য কমিয়ে আনতে। তারা এই যুদ্ধে এতোটাই বেপরয়া হয়ে ওঠেন যে একে অন্যকে হত্যা করতে ভাড়াটে খুনিও নিযুক্ত করেন।

যুদ্ধ থেকে যুদ্ধ:

১৮৯৬ সালের দিকে হলুদ সাংবাদিকতা নোংরা আকার ধারণ করে। সংবাদপত্রের সংখ্যাও তখন আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের একটু যুদ্ধ জাহাজ অবস্থান করছিল কিউবার হ্যাভেনাতে। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত যুদ্ধ জাহাজটি ডুবে যায়। নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড, নিউইয়র্ক জার্নালসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকা এর দায় চাপিয়ে দেয় স্পেনের উপর। যদিও এই ঘটনার সাথে স্পেনের কোনরকম সম্পৃক্ততা ছিল না। পত্রিকাগুলোর একের পর এক মিথ্যা সংবাদে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয় স্পেন আক্রমণে। দু দেশের মধ্যে বেঁধে যায় ভয়ানক যুদ্ধ।

যুদ্ধে দু দেশেরই সৈনিকের সাথে মারা যায় অসংখ্য সাধারন মানুষ। কিন্তু এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নানা রকমের মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে যেতে থাকে পত্রিকা গুলো। শুধু তাই নয় মিথ্যা ছবি প্রকাশ করেও তারা দেশের জনগনকে তাতিয়ে দিতো। এছাড়া যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে কিভাবে আরও বেশী করে ঘায়েল করা যায় সে চেষ্টাতেও কমতি ছিলো না নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও নিউইয়র্ক জার্নালের। সে জন্য কতো নির্মমভাবে আমেরিকানদের স্প্যানিশরা হত্যা করছে সেসবের বর্ণনাও হুবহু ছেপে দিতো পত্রিকা দুটি। এই যুদ্ধের প্রভাবে পরবর্তী বহুদিন এই দুই দেশের মানুষকে ভুগতে হয়েছে। দুই দেশের স্বাভাবিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হলুদ সাংবাদিকতার চরম মাত্রার মুল্য দিতে হয় দুই দেশের সাধারণ মানুষদের।
হ্যাঁ, এর ফলে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও নিউইয়র্ক জার্নালের ব্যবসায়িক লাভও হয়েছে। এই যুদ্ধের সময় এই দুই পত্রিকার সার্কুলেশন ছিল ১৭ লাখ।

শেষ কথা:

এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে জোসেফ পুলিৎজার এবং উইলিয়াম হিয়ার্টজ সাংবাদিকতার ইতিহাসের দুজন পথিকৃৎ। তাদের মস্তিষ্ক প্রণোদিত সাংবাদিকতার অনেক আইডিয়া এখনো বেঁচে আছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে। কিন্তু তাদের পরস্পর প্রতিযোগিতা এমন এক অরুচিকর পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে পত্রিকার বাহ্যিক চাকচিক্য আর পাঠকদের উত্তেজনা দানই তাদের নিকট মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের অহংকার, আত্মমর্যাদা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ব্যক্তিগত দন্দের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতায় যে নতুন প্রক্রিয়ার প্রচলন হয় তা আজও ক্ষতিগ্রস্থ করে আসছে সংবাদ চর্চাকে। ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা শুধু নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড বা নিউইয়র্ক জার্নালের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং ছড়িয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী।

(নাদিয়া নাহরিন, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)

Facebook Comments


এ জাতীয় আরো খবর
NayaTest.jpg