সৌদি প্রবাসী রাশেদ মাত্র ১৭ বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরবে। এ বয়সে সবাই যখন লেখাপড়া, দুরন্তপনা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সময় পার করে, তখন সবকিছু ত্যাগ করে আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে পরিবারের হাল ধরেছেন এই কিশোর। ডাল, আলুভাজি খেয়ে মাকে টাকা পাঠান, সংসারের বড় সন্তান হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে কৈশোরের আনন্দময় জীবন।
এমন বাস্তবতায় প্রবাসীদের নিয়ে নির্মিত নাটক ‘ কলুর বলদ ‘। নাটকটি যেন প্রতিটি প্রবাসীর, রাশেদদের প্রতিচ্ছবি।
কলুর বলদ নাটকে দেখা যায়
দায়িত্বশীল একজন মানুষের একা একা ভার বহনের করুণ ও নিষ্ঠূর পরিণতি। দায়িত্বের ভারে ভেঙে পড়া একজন মানুষের বাস্তব নিয়তি। দায়িত্বের এমন কর্কশতা আমাকে কী প্যাডে বসায়। ঘ্যাসঘ্যাস করে লিখে চলি পাগলের মতো। লিখতে বসে দেখি কত কথা জমে ছিল এই তিন অক্ষরের শব্দটাকে নিয়ে। দায়িত্ব। কর্তব্য। দায়ীত্ব নেয়া সরল মানুষের অবশ্যম্ভাবি শেষ পরিণতি।
টিপিক্যাল বাঙালী হিসেবে আমাদের ছোটবেলা হতেই দায়িত্ব নিতে শেখানো হয়। দায়িত্ব নেয়াটাকেই স্বাভাবিক বলে চেনানো হয়। দায়িত্ব নেবার মহান ব্রত নিতে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু কখনো কখনো দায়িত্বটাই হয়ে যায় কারো জন্য অর্পিত। চাপিয়ে দেয়া।
কলুর বলদ নামে একটি প্রবচনের ব্যবহার আছে বাংলা ভাষায়। দায়িত্বের চাপে নুয়ে পড়া মানুষটি সমাজের চোখে বাহবা কুড়ায়। সমীহ পান দশজনের চোখে। কিন্তু এই সামাজিক স্বীকৃতির মেঘে আড়াল হয়ে যায় আরেকটি সত্য। দায়িত্ববান মানুষটির নিজের জীবনটি। নিজস্ব স্বত্ত্বাটি।
বাবা-মা’র অবর্তমানে ভাইবোনদের মানুষ করতে গিয়ে একজন বড়ভাইটির জীবন সায়াহ্নে ওই ভাইবোনদের হাতেই নিগ্রহ আর অবহেলার শিকার হবার সেই অসহ্য ঘ্যানঘ্যানানি আর সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্য। অনেক সময়ই ওই দায়িত্ব নেয়াদের বিরাট ব্যক্তিত্বের আড়ালে চাপা পড়ে যাই আমরা। একসময় ভুলে যাই দায়িত্বে থাকা মানুষটিকে, তার অবদানকে। মনে হয় যেন এমনটাই হবার কথা। গা সওয়া হয়ে যায় অন্যের দায়িত্বে থাকা আমাদের নিরাপদ জীবন। চোখেই পড়ে না বিশেষ কিছু।
কিন্তু এতকিছুর ভিড়ে সেই মানুষটিকে কে দেখে? তার জন্য কে ভাবে? সবাইকে নিয়ে বাঁচতে গিয়ে, সবাইকে বাঁচাতে ব্যস্ত যেই মানুষটি, তার জন্যে কে কাজ করে? কখনো ভেবেছেন? পরিবার ও সমাজের দশটা দায়িত্ব নিতে গিয়ে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। বহু বছর বহু রকম দায়িত্ব পালন শেষে যেদিন পিছনে ফিরে তাকান তখন দেখেন, জীবনের নদীতে ভাটির টান। যাদের জন্য এতটা কাল বিলিয়ে এসেছেন নিজের জীবনের সব আশা, সব সম্ভাবনা, সব স্বাদ, আল্লাদ, সবরকম প্রাপ্যকে সমানে কোরবানী করে এসেছেন, তারা যখন প্রতিষ্ঠিত তখন সময় থাকে না তার জন্য।
দায়িত্ববান পুরুষ এবং অতঃপর তার একান্ত নিজস্ব জগত ও অধিকারের বৃত্তটুকুর অকাল মরন কেউ দেখে না। দেখে না, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য দায়ীত্ব পালন করতে গিয়ে তার নিজের একান্ত জীবন বলে আর কিছু যে থাকেনা।
একজন দায়িত্ববান বাবা বা বড় ভাইয়ের পাশে তারও যে একটি নিজস্ব জগত আছে, নিজস্ব চাওয়া, পাওনা, বাসনা, স্বপ্ন থাকে তা আমরা যেমন ভুলে যাই, হয়তো তিনি নিজেও ভুলে যান বা ভুলে থাকেন।