গোয়ালন্দ কুমড়াকান্দী ইমামবাড়ী, গোয়ালন্দ তথা দক্ষিণ বঙ্গে মহররম পর্ব প্রচারের প্রথম ইয়াদগার।
গোয়ালন্দ কুমড়াকান্দী ইমামবাড়ী সৃষ্টি ও পরিচিতি লাভের পূর্বে কেন মহররমের শোক পালন সে সম্পর্কে দুই চার লাইনে জেনে নেয়া উচিত।
৬১ হিজরী ১০ মহররম শুক্রবার মুনাফেক মুয়াবিয়ার পুত্র এজিদ বাহিনী নবী পরিবারের সন্তান ইমাম হোসাইন (আঃ) কে পরিবার পরিজনসহ কারবালার মরুপ্রান্তে নৃশংসভাবে হত্যা করে, বিশ্বের ইতিহাসে গত ও আগত দিনের নৃশংস পৈশাচিক সর্বাপেক্ষা করুন ও হৃদয়বিদারক এই ঘটনা।
মহান আল্লাহ তাঁর পাক কালামের মাধ্যমে রাসুল (সঃ) কে তাঁর উম্মতদিগকে আহলে বাইয়েত (আলী, ফাতেমা, হাসান, হোসাইন)দের প্রতি প্রাণাধিক ভাল বাসতে নির্দেশ দিয়েছেন। “হে রাসুল (সঃ) আপনি বলুন, রিসালতের বিনিময়ে আমি কিছুই চাইনা, আমার নিকটাত্নীয় (আলী, ফাতেমা, হাসান, ও হোসাইন) প্রাণাধিক ভালবাসা ব্যতিত।” – সূরা, শুরা- ২৩
নবী করিম (সঃ) তাঁর অসংখ্য হাদিসের মাধ্যমে উম্মতদিগকে তাঁর আহলে বাইয়েত প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন ও তাদের অনুসরণ করতে তাগিদ দিয়েছেন।
তিনি ইহাও বলেছেন, হোসাইন আমা হতে আমি হোসাইন হতে। যে হোসাইনকে কষ্ট দেয় সে আমাকে কষ্ট দেয়। যে আমাকে কষ্ট দেয় সে আল্লাহকে কষ্ট দেয়। মূলত ” রাসুল (সঃ) এর সন্তষ্টি তার আহলে বাইয়েতের ভালবাসার মধ্যে নিহিত”।- সহি বুখারী।
রাসুল (সঃ) এর তিরোধানের পর হতে ইসলামে নব নব বিদআতের আগমন ঘটতে শুরু করে এবং আহলে বাইয়েতের সদস্যগণ এর প্রতিবাদ করতে আরম্ভ করে। এ অবস্থায় ইমামে আযম হযরত আলী (আঃ) কে ৪০ হিজরীতে ২১ রমজান, নামাজরত অবস্থায় কুফা মসজিদে শহীদ করা হয়। তার পর ইমাম হাসান (আঃ) সেই ইসলামের ঝাণ্ডা নিজ হাতে নেন। অনেক বাধা বিঘ্ন ও প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে ৫০ হিজরীতে স্বঘোষিত মুনাফেক সাহাবি মুয়াবিয়া কর্তৃক বিষ প্রয়োগে শহীদ হন। ৫০ হিজরী থেকে ৬০ হিজরী পর্যন্ত নবীর সন্তান সেই ইসলামের তরিক নিয়ে এগুতে থাকেন। এরপর ১৫ রজব ৬০ হিজরীতে মুয়াবিয়া মারা যাবার আগে তার মনোনীত পুত্র মদ্যপ এজিদ ইসলামের তথাকথিত খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়। এজিদের পূর্ব পুরুষদের বদরের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধে শুরু হয় ইসলাম ধ্বংশের নৈরাজ্যপনা। এমন কোন অপরাধ বা ঘৃনিত কাজ যা মুয়াবিয়া পুত্র এজিদ দ্বারা হয় নাই।
৬১ হিজরী ১০ ই মহররম এর ঘটনা ছিল ইসলাম তথা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার ঘটনা।
মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে এমনই একটি দল হওয়া উচিত যারা কল্যাণের দিকে ডাকবে।” সূরা- আলে ইমরান-১০৪। আহলে বাইয়েতের পরবর্তি ইমামগন, অলী আল্লাহগণই সেই কল্যাণের পথে আহবান কারীদল।
যেভাবে কুমড়াকান্দি ইমামবাড়ি মহররম সৃষ্টি হলো
বৃটিশ ভারতের এলমে তাসাউফের অন্যতম প্রচারক গড়পাড়া ইমামবাড়ী দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা অলী এ কামেল শ্রেষ্ঠ সূফী সাধক হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুর রহমান (রহঃ) পবিত্র কারবালার মহান শহীদানদের স্মরনে পবিত্র মহররম শুরু করেন। দীর্ঘদিন পাক-পাঞ্জাতনের আদর্শ প্রচার করে বাংলা ১৩০০ সনের ২৭ কার্তিক তিনি ইন্তেকাল করেন। এই মহান তাপস পরলোক গমনের পর তাঁর সুযোগ্য দ্বিতীয় শাহাজাদা অবিভক্ত বাংলার বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ত্বরিকত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র পীর এ কামেল হযরত শাহ্ খলিলুর রহমান (কুঃ ছিঃ) খেলাফত প্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন ভারতের দেওবন্দ থেকে আরবী ও ফার্সীর উপর মওলানা ডিগ্রীধারী। বাংলা ১৩৩৩ সনে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা ও জাগরণের উদ্দেশ্যে তৎকালিন মানিকগঞ্জ থানার গড়পাড়া হাট খোলায় বহুভাষাবিদ ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সহ বৃটিশ ভারতের বিভিন্ন জেলা হতে প্রসিদ্ধ আলেম ওলামাগণদের নিয়ে ঐতিহাসিক বিরাট ইসলামী সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। কারবালার মহান শহীদানদের শাহাদৎ এর প্রকৃত নিগুর তত্ব আশেকান ও ভক্তবৃন্দের মধ্যে ব্যপকভাবে প্রচার করেন। তিনি ১ লা মহররম হতে ১০ ই মহররম (আশুরা) ভাব-গাম্ভীর্য ও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করেন।
সাবেক বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বিশেষ করে দক্ষিন বঙ্গের দ্বার গোয়ালন্দ এলাকার অসংখ্য মুরিদ ও পীর ভাইগণ পবিত্র মহররমের কাসেদ ও তাজিয়া মিছিলে গড়পাড়া দরবার শরীফে গিয়ে অংশ গ্রহন করতেন। এখনকার মত তৎকালীন যুগে যাতায়াত ব্যবস্থা ততো ভাল ছিল না। বিশাল পদ্মা নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে মানিকগঞ্জের গড়পাড়া দরবার শরীফে পৌঁছাতে হতো। সেইদিক বিবেচনা করে পীর এ কামেল হযরত শাহ্ খলিলুর রহমান (রহঃ) সাবেক বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার ভক্তবৃন্দর মহররম পালনের জন্য গোয়ালন্দ এলাকায় একটি ইমামবাড়ী স্থাপনের কথা মনে মনে ভাবতে ছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় ৯০ বছর আগে ১৯৩০ সালের কোন এক শীতের সময় বাদ ফজর গড়পাড়া ইমামবাড়ীর দরবারের হযরত শাহ খলিলুর রহমানের নিজ হুজরা খানায় বসে আছেন, সামনে নতশিরে বসে আছেন জনাব নেন্দু খাঁ মুন্সি, দুইজন অনেকটা বর্জকের হালতে। হঠাৎ পীর সাহেব বললেন, মুন্সি! আহলে বাইয়েতের গোলামী, নবীর বংশের রেখে যাওয়া কাজ, তাদের ফরমান তোমাদের পদ্মার পারে দক্ষিন অঞ্চলেও শুরু করা লাগবে!
স্বীয় পীরের ইচ্ছা আদেশ পালন করা ইবাদত, মনে করে নেন্দু খাঁ মুন্সি আনন্দে চিত্তে রাজি হোলেন।
পদ্মাপারে দক্ষিন বঙ্গে ইসলামের হক প্রতিষ্ঠায় আওলাদে রাসুল (আঃ) এর স্মৃতি চারণে পবিত্র মহররম পর্ব পালন হবে বলে অত্র অঞ্চলের সকল ইমাম ভক্তদের মনের মধ্যে ভাব গাম্ভির্জতা বিরাজ করতে ছিলো। জিলহজ্জ্ব মাসের শেষের দিকে মহররম আরম্ভ হবে এমন সময় গোয়ালন্দর কয়েকজন ভক্তকে দরবারে ডেকে পাঠালেন এবং তাদের কাছে মহররম পালনের উপকরণ হিসেবে ইমম হোসাইনর (আঃ) এর মাজার শরীফের কাঠামো বা স্মৃতি নঁকশা, ডাল, তরবাড়ি, রুমাল, নিশান দিলেন। ভক্তগণ তাজিমের সহিত গ্রহন করলেন।
ভক্তবৃন্দদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, আতর আলী ব্যাপারী, পরান মন্ডল, বিদেশী মন্ডল, মাদারী খাঁ।
উপকরণগুলোর মধ্যে সবকিছু বহন করা সহজ হলেও ইমাম পাকের স্মৃতি নঁকসা বহন করা ছিল স্পর্শকাতর বিষয় এবং এটি ছিল লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা। তখনকার যুগে এই নঁকশার ব্যপারে অনেকেই অকিবহাল ছিল না। মানিকগঞ্জ হতে গোয়ালন্দ পর্যন্ত হেঁটে নৌকায় আসতে পথিমধ্যে অনেক লোকের সাথে দেখা হবে যে কেউ প্রশ্ন করলে কি উত্তর দিবে এই ভাবনায় ভক্তরা একে অপরের দিকে তাকাতাকি করতে শুরু করেন। হুজুর কেবলা হযরত শাহ্ খলিলুর রহমান (রহঃ) ভক্তদের মনের ভাব বুঝতে পারনে, তিঁনি চোখ বুজে স্বল্প বর্জক করে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলেন, “তোরা সম্মানের সহিত এগুলো ইমাম বাড়ীতে নিয়ে যা, পথিমধ্যে কেউ কিছু জিগ্যাসা করবে না।” অলীদের কি মজিজা সত্যি সত্যিই পথিমধ্যে এবং নদিতে নৌকার মধ্যে অনেকেই দেখে কানাকানি করতে লাগল কিন্তু কেউ জিগ্যাসা পর্যন্ত করলো না।
ভক্তবৃন্দের এই দলটি ইমাম বাড়ীর কাছাকাছি পৌছালে গড়পাড়ার একজন ইমাম ভক্ত ও আশেকান জনাব ফটিক শেখ রওজা শরীফের আকৃতি দেখে বেহুশ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে এই বেহুশ হওয়ার বর্ননায় তিনি খোদার পুরো আরশকেই দেখার কথা প্রকাশ করেন।
গড়পাড়া থেকে বহন করে আনা ইমাম হোসাইন (আঃ) এর রওজা শরীফের স্মৃতি নঁকশা আজ ৯০ বছর যাবৎ গোয়ালন্দ (কুমড়াকান্দী) ইমামবাড়ীর রওজা মোবারক ঘরে নিজ আসনে অধিষ্ঠিত আছে, ডাল-তরবারী তখন থেকেই ১নং দলের কাসেদদের দলপতি ব্যবহার করে আসছেন।
গড়পাড়া ইমামবাড়ির নির্দেশক্রমে ভক্তবৃন্দ ও ইমাম ভক্তগনের সাহায্য ও সহযোগিতায় গোয়ালন্দ কুমড়াকান্দীর নেন্দু খাঁ মুন্সির বাড়ীতে (বর্তমানে যেখানে অবস্থিত) তৈরী করা হয়েছিল একখানা চৌরীঘর।
অত্রঅঞ্চলের বিভিন্ন মহলে যয়নবি পয়গাম পৌঁছােতে ইমাম হোসাইন (আঃ) ঝাণ্ডা বহণ করে শুরুতে গোয়ালন্দ (কুমড়াকান্দী) ইমামবাড়ী থেকে ১টি কাসেদের দল বেড় হতো, কিন্তু মহলে গিয়ে ২টি দলে ভাগ হযে যেতো। রাত্রে কাসেদবৃন্দ মহলেই ভক্তবৃন্দের বাড়ীতে অবস্থান করতো সেই ধারাবাহিকতায় এখনও করে।
প্রথম দলপতি হিসেবে এবং মূল দলের নেতৃত্বে ছিলেন জনাব মোঃ ফটিক শেখ। এবং মহলে গিয়ে দুই দলে বিভক্ত হয়ে উপ দলের নেতৃত্বে থাকতেন মোঃ আবু বকর মৌলভি ওরফে শাহ্ সাহেব(শাহ্ সাহেব এর বাড়ী ছিল বরাট, এখনও উনার মাজার প্রাঙ্গনে প্রতি বছর বিরাট ওরশ ।অনুষ্ঠিত হয়) তিনি ছিলেন পাকা এলেমধারী ব্যাক্তি এবং এই অঞ্চলের প্রথম মেদিনীপুরের মুরিদান ছিলেন। প্রায় ১২ বছর কাটিয়েছেন মেদিনীপুর হুজুরের কাছে।সেখান থেকে পীরের নির্দেশক্রমে অর্থাৎ মেদিনীপুর পীরের বন্ধু হযরত শাহ খলিলুর রহমান আল কাদরী আল চিশতি ওয়াল আবুল ওয়ালাই সাহেবের খেদমতে মশগুল থাকতে পূর্ব বঙ্গের গড়পাড়ায় প্রত্যাবর্তনের নির্দেশপ্রাপ্ত হন।পরবর্তীতে গড়পাড়ার এই হুজুর কেবলার অনুমোতিতে গোয়ালন্দ কুমড়াকান্দি ইমামবাড়ীতে শোক পালনের আদেশ প্রাপ্ত হন। মূলত তখনকার সময় এই শাহ্ সাহেবদের মতো পরহেজগারদের ততো বড় বড় ডিগ্রী ছিলনা কিন্তু প্রকৃত এলেম ছিল, কোরআন,হাদিস তারা রিসার্স করতেন, তারা ছিলেন প্রকৃত বুজর্গানে দ্বীন। বর্তমানে কিছু নামধারী আলেম আছেন,নামের সাথে বড় বড় ডিগ্রী যুক্ত করেন কিন্তু ইসলামের ইতিহাসটাই কোনদিন পড়েন নাই। ওস্তাদ কি বলেছে, অমুক কি বলেছে তাই শুনে শুনে ওয়াজিন হয়েছেন, ওটা সত্য কি মিথ্য তাও যাচাই করেন না।
ফটিক শেখ, শাহ্ সাহেব দলপতি হলেও ঐ সময়ে তারাও বয়াতীও ছিলেন। তাদের সাথে বয়াতি হিসেবে জারী পরিবেশন করতেন, মনসুর মন্ডল, আমোদ আলী মোল্লা ও মাইনদ্দিন খাঁন।
প্রথম পর্যয়ে যারা কাসেদ সাজতেন বা কাসেদ হতেন তাদের পরহেজগারীতা ছিল প্রকৃত আহলে বাইয়েত অনুসারী বা ইমাম ভক্তর।তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য যেমন, ফটিক শেখ, নেন্দু খাঁ মুন্সি, মনসূর বয়াতি, হাকিম আলী ফকীর, হাছেন খা, মজির খা, আজগর মল্লিক, জুড়ান মল্লিক, ইসমাইল মল্লিক, হাতেম বয়াতি, হকাই শিকদার, আইজদ্দিন খাঁ, পাইজ মন্ডল, দিরাজ মন্ডল, বিদেশী মন্ডল, বাহাদুর মন্ডল, শফিউল্লাহ সাহেব, ফৈজদ্দিন শেখ, রহমান শেখ, তিলাপ শেখ, ইন্তাজ মিস্ত্রী, আতর অালী শেখ, আরজান মন্ডল, মাদারি খা, গেন্দু সরদার, লাল চাদ মিস্ত্রী, মৈজদ্দিন শেখ, পরান মন্ডল, গোখুর মন্ডল, মিনাজ উদ্দিন কাজী, কালা বকসী, ধলা বকসী, সাকী মোল্লা, কানাই সরদার, যয়নাল সরদার, রহমত মোল্লা, আব্দুল আজিজ মন্ডল, বাজু নলিয়া, হাশেম মুন্সি (ফরিদপুর গোলডাঙ্গির চর), মনসুর মন্ডল, নূরু সরদার, খোরশেদ মোল্লা, চাদাই শেখ, বাদাই শেখ সহ ৭০ থেকে ৮০জন কাশেদ নিয়ে দল বের করা হয়।
কাসেদের দলটি কুমড়াকান্দি ইমামবাড়ী থেকে বেড় হয়ে ফরিদপুর নর্থ চ্যানেল কামারডাঙ্গী আদু মল্লিকের পাড়া বা নবুগ্রাম, উজানচর হাবিল মন্ডল পাড়া, সাভারের কানু মোল্লার পাড়া বা রাধাকান্তপুর, চাঁনপুর, বসন্তপুর, মগবুলের দোকান বালিয়াচরসহ প্রভূতি এলাকা পদির্শন করেন ৯ ই মহররম রাত্রে ইমামবাড়ীতে ফিরে আসতো। ১০ই মহররম শোক মিছিলে মহররমের নিশান তরবারী, দুলদুল ঝাণ্ডা থাকলে তাজিয়া তখনও তৈরী করা হয় নি। প্রায় ৩৮/৩৯ বছর পূর্বে (১৯৮১/৮২ ইং সনের দিকে) গড়পাড়া থেকে তাজিয়া তৈরী করার জন্য জনাব কালাম উদ্দিন কারিগর এসে ছিলেন, তিনি আতর আলী ব্যপারীর বাড়ীতে থাকতেন ও খাওয়া দাওয়া করতেন এবং ইমামবাড়ীতে এসে পবিত্র তাজিয়া শরীফ এর কাঠামো তৈরী করতেন। সম্ভাবত ১৯৮২ ইং সালে আশুরার শোক মিছিলে প্রথম তাজিয়া মিছিল বেড় করা হয়। প্রথম তাজিয়া মিছিলে অত্র অঞ্চলের সকল ধর্মের লোকদের তাজিয়াকে তাজিম করতে দেখেছি। তাজিমের সহিত তাজিয়াকে নজরানা প্রদান আর কারবালায় নবী পরিবারের নারী শিশুদের কষ্টের কথা স্বরণ করে দুলদুলের পায় এবং তাজিয়ার খাটিয়ায় ইমাম ভক্ত হিন্দু মসলিমদের যে পরিমান দুধ ঢালতে দেখেছি মহররম মাস আসলেই আজও আমার চোখে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠে।
লেখক-এস এম সিরাজুল ইসলাম
ইমামবাড়ীতে তখন খাদেম প্রথা বিদ্যমান ছিল,প্রথম খাদেম ছিলেন মোঃ ফৈজদ্দিন শেখ যিনি ফজু খলিফা নামে পরিচিত ছিলেন, এই ফৈজদ্দিন শেখের জীবনী থেকে জানা যায়, ইমাম ভক্ত আর পীরের গোলাম কাকে বলে তা ফৈজদ্দিন শেখের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। সারা জীবন পরহেজগারীতার মধ্যে দুঃখ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করলেও মহররম মাস আসলে কারবালায় নবীপরিবারের শোকে উনি কাতর হয়ে যেতেন। ঐ ১০ দিন কারবালায় নবী পরিবার যা খেয়ে জীবন কাটিয়েছিন উনিও তাই খেয়ে রোজা পালন করতেন। আগুনে তৈরী কোন কিছু স্পর্শ করতেন না। একমুষ্ট মুড়ি, একটা খেজুর খেয়ে শেহেরী আর একগ্লাস গুড়ের শরবত দিয়ে ইফতারী। উনার আরেকটি বিষয় ছিল, উনার কাছে সবসময় বড় পীর সাহেবের সিরনি পবিত্র নেওয়াজ পাক সংরক্ষিত থাকতো। বিভিন্ন সমস্যার তখর বড় দাওয়াই ছিল পবিত্র নেওয়াজ পাক। যার খুব প্রয়োজন হতো সে চলে আসতো ফৈজদ্দিন শেখ বা ফজু শেখের কাছে, একটা ছোট্ট কৌটায় সারা বছর তিনি এই পবিত্র বস্তু সংরক্ষণ করতেন শুধু মানুষের উপকারের জন্য। হ্যাঁ, এই ফৈজদ্দিন শেখ বা ফজু শেখকে চিনতে হয়তো অনেকেরই একটু কষ্ট হইতেছে, তাকে চিনার জন্য সহজ করে দেই, আতর আলী বেপারী ছিলেন তার বড় জামাতা (অর্থাৎ তিনি আতর আলী বেপারীর শশুর ছিলেন), তার মেঝো জামাতা ছিলেন আজগর আলী শেখ (আজু খলিফা), যার নামে কুমড়াকান্দী গ্রামে ১৯৮৯ ইং সালে একটি পবিত্র ১১-ই পাক ঘর নির্মিত হয়েছে।
তারপর পর্যায়ক্রমে মোঃ হাকিম আলী শেখ, মোঃ লাল খাঁ, মোঃ নেন্দু খাঁ মুন্সি, মোঃ ফটিক শেখ, মোঃ ইন্তাজ উদ্দিন শেখ (ইন্তাজ মিস্ত্রি বলে যিনি পরিচিত)।
তারপর ইমাম ভক্ত ও আশেকানে আওলাদে রাসুল (সঃ) দের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কাসেদের দলের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় বর্তমানে ৫টি দল বেড় হয়। ১৯৮৫/৮৬ সালের দিকে ৮,৯,১০ ই মহররম ইমামবাড়ী থেকে স্পেশাল দলও বেড় হতো। ইমাম হোসাইন (আঃ) ও রসুল (সঃ) এর পরিবার পরিজনদের শোকে শোকাহত হয়ে আগে শোক মিছিলে সমস্ত ইমাম ভক্ত, কাসেদ বৃন্দ ও আশেকানগণ অংশ নিতেন।
শোক মিছিলের নেতৃত্ব দিতেন ইন্তাজ উদ্দিন শেখ ইন্তাজ মিস্ত্রি সাহেব। আর হযরত শাহ খলিলুর রহমানের নির্দেশক্রমে শাহ্ সাহেব চলে যেতেন পড়পাড়ায়। নিশান, ডাল-তরবারী, বাদ্যযন্ত্র. দুলদুলসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদী নিয়ে আহলে বাইয়েতের নামে, ইমাম হোসাইনের নামে উচ্চ স্বরে ধ্বনি সহকারে শোক মিছিলটি গোয়ালন্দ বাজার প্রদক্ষিন করে যখন ইমাম বাড়ীতে ফিরে আসতো মিছিলে অংশ গ্রহনকারী আর ইমামবাড়ীতে অবস্থানকারী ইমাম ভক্তদের আহাজারীতে ইমামবাড়ী কারবালায় পরিনত হতো।
সুদূর মানিকগঞ্জ হতে পায়ে হেঁটে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে হোসাইনী স্মুতি নঁকশা নিয়ে সহজে গোয়ালন্দ কুমড়াকান্দী ইমাম বাড়ীতে পৌঁছানো গেলেও নবীর বংশের আদর্শ, রসুল (স) এর নির্দেশনা প্রচার করা কিন্তু সহজ ছিল না। প্রথম দিকে এলাকা এবং এলাকার বাইরেও বিভিন্ন রকমের বাঁধার সম্মুখিন হয় কাসেদবৃন্দ ও ইমাম ভক্ত গণ । যেমন, কুমড়াকান্দি এলাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় কাসেদের শুনতে হয়েছে অশ্রাভ্য ভাষায় শিরক, বেদআত, নাযায়েজ কাফেরদের কাজসহ বিভিন্ন প্রকারের গালমন্দ । নাজেম মন্ডলের নাতি মতি দারোগার ছেলের দ্বারা কটাক্ষ ও কটুক্তির একপর্যায়ে ইনতাজ মিস্ত্রির সাথে চরম বাকবিতণ্ডা হয়। সেই মতি দারোগার ছেলের অসভ্য আচরণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেন আহেলে বায়েতের আশেকান ও একনিষ্ঠ ইমামভক্ত আহমদ আলী মোল্লা। মকবুলের দোকান বা বাইলে চর, শমশের মাতব্বর কাসেদের প্রচারে ব্যাপক বাঁধা প্রদান করে। আর কুমড়াকান্দিতেও দুটি পরিবার প্রথম বাঁধা প্রদান করে।
এই সমস্যা সমাধানে কুমড়াকান্দি ঈদগাহ মাঠে ( বর্তমানে গেন্দু সরদার ঈদগাহ ময়দান)অত্র এলাকার মান্যগণ্য ব্যক্তিবর্গ এবং গড়পাড়ার পীর সাহেব কেবলা হযরত শাহ্ লতিফর রহমান (যিনি পাগলা পীর সাহেব বলে পরিচিত , তিনি ভারতের দেওবন্দ থেকে আরবী ও ফার্সী ভাষায় মওলানা পাশ করা ছিলেন) এর উপস্থিতিতে এক শ্রেণীর আলেম সম্প্রদায় ও ইমাম ভক্তগণের সাথে বাহাজ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ইমাম ভক্তগণ জয়লাভের মাধ্যমে তাদের শোক পালন ও প্রচারের বৈধতা পেয়ে যান।
এখানে একটি বিষয়ে উল্লেখ না করলেই নয়, ১৯৬৮/৬৯ সালের দিকে, তৎকালিন গড়পাড়া ইমামবাড়ী দরবার শরীফের গদ্দীনশীন পীর এ কামেল হযরত শাহ আমিনুর রহমান ও হযরত শাহ মোখলেছুর রহমানের বিশেষ অনুরোধে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্থানের ওয়েল কোম্পানির মহা ব্যবস্থাপক গড়পাড়া দরবারের কৃতিসন্তান জনাব আলমগীর এইচ রহমান সাহেব গোয়ালন্দ কুমড়াকান্দী ইমাম বাড়ীতে আসেন। তিনার ইচ্ছা ছিল ইমামবাড়ীটি পাকা করে অত্র অঞ্চলের মধ্যে একটি আকর্ষনীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ করে দিবেন এজন্য তিনি নগদ টাকাও সঙ্গে করে নিয়ে এসে ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ইমামবাড়ীর জমি ইমাম বাড়ীর নামে দান বা দলিল করা ছিল না এবং কি যাদের আয়ত্বে জমি ছিল তারাও ইমামবাড়ীর জন্য জমি দিতে অস্বিকার করে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্বেও তিনি ইমামবাড়ী তৈরী করে দিতে ব্যর্থ হন।
এদিকে ফটিক শেখের কবর দেয়া হয়েছে ইমামবাড়ীতে। হযরত শাহ্ খলিলুর রহমানের একান্ত ইচ্ছা ছিল, ফৈজদ্দিন শেখ, ইন্তাজ মিস্ত্রি এরকম একনিষ্ট পরহেজগার ভক্তবৃন্দের কবর হবে এই ইমামবাড়ীতে। কিন্তু জমির মালিকানা জটিলতা দেখা দেয়ায় তা আর সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় জনাব আতর আলী বেপারী, আবুল হোসেন মেম্বর, আব্দুস সাত্তার শেখসহ সবাই মিলে অর্থ সংগ্রহ করে, নেন্দু খাঁ মুন্সির বংশের ওয়ারিশদের থেকে ইমামবাড়ীর জমি দলিল করে নেয়া হয়। জমি দলিল হয় হযরত শাহ্ আমিনুর রহমান ও হযরত শাহ মোখলেছুর রহমানের নামে।
ইমামবাড়ীতে সামা মজলিশ পরিবেশন করতে প্রথম হারমুনিয়ামটি দান করে সেকেন আলী শেখ। এভাবে অত্রঅঞ্চলের ইমাম ভক্তদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহযোগিতা ও অংশগ্রহনের মাধ্যমে গোয়ালন্দ কুমড়াকান্দী ইমামবাড়ী প্রতিষ্ঠিত।
লেখক-এস এম সিরাজুল ইসলাম।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কর্মরত।