আমরা মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই সুখের অন্বেষণ এ ছোটা শুরু করি। আদিম কাল থেকেই মানব তা করে আসছে।
সবাই শুধু সুখী হতে চায়, কেউ দুঃখ চায় না!!এ জগৎ সংসারে কোনো দুঃখবোধ নাই এমন একজন সুখী মানুষের সন্ধান লাভ কি আদৌ সম্ভব? সেই সুখী মানুষের জামা পাওয়ার গল্পের মতোই হয়তো!! প্রকৃত সুখী হওয়া আদৌ সম্ভব কিনা এ নিয়ে সুখবাদী দার্শনিকরা নানারূপ তত্ত্ব, মতবাদ দিয়ে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠা করার নানামুখী যুক্তি প্রয়োগের অপচেষ্টা করেও মানুষকে ১০০ শতাংশ সুখী বানাতে সমর্থ হননি! হয়তো কোনোদিন হবেন ও না!! সুখের জন্য কিছু চাইতে গেলে প্রায়ই তা পাওয়া যায় না বরং বিদ্যমান সুখও চলে যায়। এটা অনুধাবন করেই কবিগুরু বলেছেন, ‘তারা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, সুখ চলে যায়’। জ্ঞানদাসের কবিতায় পড়েছিলাম “সুখের লাগি এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল।
প্রকৃত অর্থে,জীবন বৈচিত্র্যতায় ভরা। প্রতিটি মুহূর্তে কী ঘটতে যাচ্ছে এক অন্তর্যামী ছাড়া আর কেউ জানেন না। জীবনের পরতে-পরতে মিশে থাকে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভাল-মন্দের নানান সমাহার। কোন মানুষই বিপদ-আপদ বা অন্তহীন সমস্যার বাইরে নয়। আর এই শত সমস্যার ভিড়েই আমাদের নিরন্তর পথচলা। কিন্তু আমরা অনেকেই অপ্রত্যাশিত এসব প্রাপ্তি মোকাবিলায় প্রস্তুত নই বলে কোন ছোট-বড় সমস্যা সামনে উপস্থিত হলেই সুষ্ঠু সমাধানের চিন্তা বাদ দিয়ে কষ্টে-শোকে ঝরা পাঁপড়ির মত ঝরে পরতে থাকি। দুঃখ বিলাসী বিষণ্ণ মনকে আঁকড়ে ধরে জীবনকে করে তুলি মরুভূমি, বিষাদময়। যা অর্থহীন ও সুস্থবিবেক বা সুচিন্তাপ্রসূত তো নয়ই বরং মানবিক দৃষ্টিবোধ সম্পন্নতার প্রকাশও নয়। এতে ব্যক্তি জীবন যেমন আক্রান্ত হয় তেমনি নষ্ট হয় পারিবারিক ও সামাজিক জীবনও। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জীবনবোধ আছে, আছে চিন্তা-ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। তবে জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হবে এটা যেমন ভেবে রাখা অনুচিত তেমনি না পাওয়ার বেদনায় পুরো জীবনটাকে অভিশপ্ত বা বেদনার্ত করারও কোন মানে হয় না।
অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞানে দেখেছি যারা সাধ্যের চেয়ে বেশী প্রত্যাশা করে না, অল্পে তুষ্ট থেকে জীবনকে জীবন দর্পণে সংজ্ঞায়িত করে তারা চলার পথে কখনও হোঁচট খেলেও সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে অপ্রতিরোধ্য বাসনায় সম্মুখপানে এগিয়ে চলে। নব উদ্যম-উদ্দীপনায় জীবনকে সাজাতে থাকে অদম্য স্পৃহায়। আর এরাই হয় বিজয়ী, সফলকাম ও সুখী হন।মনের ভিতর থেকে সুখ এবং দুঃখবোধ হামেশাই তৈরি হয়। প্রত্যাশার প্রাপ্তি থেকে সুখ এবং অপ্রাপ্তি থেকে দুঃখ- এ দু’য়ের মাঝামাঝি কোনো তৃপ্তিবোধ না থাকায় মানুষ নিজেকে কেবল সুখী বা দুঃখী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুখ আর দুঃখের মাঝামাঝি একটি অবস্থান তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া পরের সুখে সুখী হওয়ার মাঝেও সুখ পাওয়া যেতে পারে।কামিনী রায় যেমনটি বলেছিলেন:
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি নাও
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
আমার অভিজ্ঞতা বলে এ ফর্মুলাতে একমাত্র মহামানবরাই সুখী হন,আমরা আমজনতা এর মধ্যে পড়িনা!!!!
অন্যঅর্থে যদি আমরা ভাবি , জীবনটা আসলে একটা ইলুসন বা মায়া বা খানিকটা ম্যাট্রিক্সের মতো,এইখানের সবকিছুই ক্ষনস্থায়ী। তাহলে কেন আমরা দুঃখে মরি? কেন আমরা নিজেকে শত বেড়াজালে আটকে ফেলি? কেন ভয় পাই এ্যাডভেন্চার খুঁজে পেতে? কেন ভয় পাই দুঃখি হতে? মানুষের জীবনে দুঃখ আসবেই। কিন্তু সেটাতে আটকে না গিয়ে বৃহত্তরভাবে যদি আমরা দেখতে পাই তাহলে সেটা কতো সহজ হয়ে যায়। সেটা হচ্ছে এই সব কিছুই একদিন চলে যাবে। এই আমাদের প্রিয় জন, তারা কেউ সারা জীবন থাকবেন না। আমরাও থাকবোনা। জীবনে অনেকের অনেক রকম ট্র্যাজিডি আছে। বুঝতে হবে, সেই দুঃখ গুলো একসময় থাকবেনা। সেই কঠিন সময়ে ধৈর্য ধরে সুখের পথ যারা খুঁজে নিতে পারে, তারাই প্রকৃত বুদ্ধিমান।
আমি নিজে অনেক দুঃখ বিলাসি বন্ধুকে দেখেছি জীবনে। এখনো দেখি শুধু দুঃখ ছাড়া আর কিছু তাদের মাঝে নাই!! কিন্তু এইভাবে নিজেকে দুঃখ দিয়ে কি লাভ বলুন? যারা জীবনটা যেভাবে দেখে, বা চায়, তারা জীবনকে সেইভাবেই পায়। যারা দুঃখ খুঁজে, তারা শুধু দুঃখই পাবে। আর যারা সুখ খুঁজে, তারা সুখ!!বলার প্রয়োজন নেই, সবাই সুখি হতে চায়। কিন্তু সুখি হতে সাহস লাগে, আর চেষ্টা করতে হয়। সুখ খুঁজে নিতে হয়। নিজের হাতে এসে সে ধরা দেয় না। কিন্তু সুখ কোন সোনার হরিনও না যে তাকে পাওয়া অসম্ভব!! মানুষের জীবনে খারাপ সময় আসেই, মানুষ মাত্রই ভুল করে। সেই ভুল আবার মানুষ শুধরেও নিতে পারে। প্রত্যেক মানুষ খুব স্পেশাল।সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, আমরা স্পেশাল না হলে নিশ্চয় পাঠাতেন না? মনে রাখা দরকার সৃষ্টিকর্তা আমাদের ভালবাসেন। আমাদের সুখি দেখতে চান। আমরা চাইলেই কিন্তু সুখটা খুঁজে নিতে পারি।এক্ষেত্রে একটা জিনিস আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মনের নিয়ন্ত্রণ তো পুরাপুরি আমাদের আছে। মনে করতে হবে আমার মন ভালো, নিজেকে বলতে হবে, এমন কিছু করতে হবে, যা মন ভাল করে দেবে। মন খারাপের কথা গুলো কোনভাবেই চিন্তা করা যাবেনা। এক সময় দেখবেন সত্যি সত্যি মন ভালো হয়ে গেছে।
যাপিত জীবনে দেখেছি সুখের স্মৃতিগুলো মালাবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় সুখের অস্তিত্ব যেখানে সংকটাপন্ন ভাবি, সেখানে কীভাবে তৈরি হবে মালাটি। একটা চাকরি পাওয়ার পর যে সুখ অনুভূত হয়, বেতনের টাকায় চলতে না পারায় সে সুখ উবে যায়, ঊর্ধ্বতনদের দাপুটে আচরণে কখনো নিজেকে অসহায় মনে হয়, পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার পর জীবন বিষাদময় হয়। এভাবে প্রতিটা সুখকেই কেবল সম্পূর্ণ ক্ষণস্থায়ী একটি অনুভূতি ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয় না। এভাবে সব সুখই এক সময় অসুখী হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। কাজেই ধার করে ঘি কিনে খেয়ে সুখী হওয়ার চেয়ে প্রকৃত সুখ অন্বেষণের পথ খুঁজে বের করাই উত্তম
বর্তমান সমাজ পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, জীবন ও সুখ চলমান বহতা নদীর মতো।যারা প্রকৃতসুখ প্রত্যাশী তাদের উচিৎ শান্তি বিনষ্টকারী বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা বিষয়কে সুন্দর মন নিয়ে মোকাবিলা করা। আর তা সম্ভব না হলে কৌশলে এড়িয়ে চলা।
মোহাম্মদ আলী।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষার্থী,বর্তমান জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত)