মু. জাহাঙ্গীর হোসেন (সাচ্চু) ||
শিক্ষা বিস্তারের এক ঐতিহাসিক প্রাণপুরুষ বাবু নরেন দত্ত, যিনি ছিলেন অত্র এলাকার প্রথম গ্রাজুয়েট। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরর অধিনে কলিকাতা স্কলাস্টিক চার্চ কলেজ থেকে বি,এ পাশ করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নিকটতম বন্ধু। সেই সুবাদে নেতাজীর স্বরাজ আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি কিছুদিন বৃট্রিশ সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বরাজ আন্দোলনের কারনেই তিনি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে সোজা গ্রামের বাড়ি চলে আসেন।
তিনি এলাকার আপামর জনমনে শিক্ষার আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলনের এক দীপ্ত প্রত্যয় নিয়ে ১৯২৪ সালে জনাব ইয়াছিন মিয়া, প্রিয়শংকর পোদ্দার, তারকনাথ ডাক্তার, এশারত প্রেসিডেন্ট, আঃ হাকিম চৌধুরী, আফসার চৌধুরী, দাদালী মিয়া প্রমুখ ব্যক্তির সক্রিয় সহযোগিতায় পুরাতন বরাট হাটের পাশে খালের পশ্চিম পাশে এম, ই স্কুল নামে একটি স্কুল প্রতিষ্টা করেন। এই সময় বরাট মক্তবটি এই স্কুলের সাথে সমন্বয় হয়ে যায়। বরাট এম,ই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহন করেন বাবু নরেন দত্ত। আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকেন জনাব রহিম উদ্দিন মুন্সি। এ সময় হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যাঁনারা কর্মরত ছিলেন তাঁরা হলেন সর্বজনাব নরেন দত্ত বি,এ বরাট, নাজির হোসেন, রাজবাড়ী, মোঃ আনোয়ার হোসেন, বাগমারা, রাজবাড়ী, ভবানী শংকর বিএসসি, খানখানাপুর, বীরেন্দ্র কুমার মজুমদার, আই,এ, কাশিমা, শিশির কুমার লাহিড়ী, আই,এ, বালিয়াকান্দি, বিধুভূষণ দেব রায়, পন্ডিত লৌহজং, মোঃ মজিদ মিয়া, বি,এ, খানখানাপুর ও দক্ষিণারঞ্জণ সরকার,আই,এ, বসন্তপুর, প্রমুখ।
লেখক, মু. জাহাঙ্গীর হোসেন (সাচ্চু)
এখানে উল্লেখ থাকে যে, এই সময় প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ছিল না। ১৯৪২ সনে বৃট্রিশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ঘোষণা করার ফলে এম,ই স্কুল সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এ সময় বাবু সমরেন্দ্রনাথ রায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৪২ সালে যোগদান করেন। সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জনাব মোবারক হোসেন মিয়া, শ্রী ননীগোপাল দাস ও প্রফুল্ল ঘোষ।
১৯৪৩ সনের এপ্রিল মাসে রেলওয়েতে বাবু সমরেন্দ্রনাথ রায় মহাশয়ের চাকুরি হওয়ায় তিনি এ পদে ইস্তফা দিলে ভবানী প্রসাদ ঘোষ (গ্রাম জয়পুর) প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় কাজী মোজাম্মেল হক সাহেব কিছুদিন সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৪৩ সনের শেষের দিকে পদ্মানদীর ভাঙনে নদীগর্ভে জনপদ বিলীন হয়ে যায়। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে গড়া সাজানো গোছানো লোকালয়। এলকার সুধী স্বজনের তত্ত্বাববধানে স্কুল ঘরটি ভেঙে এনে দীর্ঘদিন বর্তমান বরাট হাসপাতাল প্রাঙ্গনে জমা করে রাখা হয়। এ সময় হাসপাতালের পাশেই দাদালী মিয়ার কাচারি ঘরে ও চৌধুরী বাড়ির কাচারি ঘরে কিছুদিন শ্রেণিকার্য পরিচালনা করা হয়। অতঃপর এলাকার বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিগণ স্থায়ীভাবে বিদ্যালয় গৃহটি পুনঃ প্রতিষ্টার জন্য তৎপর হন এবং সর্বসম্মতিক্রমে বর্তমানস্থলে বাগচী বাবুদের প্রদেয় জায়গায় বরাট উচ্চ বিদ্যালয় এবং তৎ সংলগ্ন ফ্রি প্রাইমারি স্কুল নামে পুনঃ প্রতিষ্টিত হয়। এখানে উল্লেখ থাকে যে, ইতোপূর্বেই বাগচী বাবুদের বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ের প্রাথমিক বিদ্যালয় ডা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত চালু ছিল তাও ঐ স্কুলের সাথে সমন্বিত হয়ে যায়।
এই সময় বরাট ভাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে রাজবাড়ী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়পুর নিবাসী বাবু ক্ষিতিশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় যোগদান করেন। অন্যান্য শিক্ষকগণ ছিলেন সর্বজন বাবু মণীন্দ্রভূষণ বাগচী, পরেশ চন্দ্র গোস্বামী, ফণীভূষণ গোস্বামী, যোগেশ চন্দ্র সূত্রধর, শামসুল হক মৌলভী, কালিপদ বাবু, শ্যামরঞ্জন গোস্বামী ও বাবু কুমুদ বন্ধু পাল। দপ্তরি হিসেবে ছিলেন জগা দাস। ১৯৪৯ সনে প্রাইমারী সেকশনে রাজাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে বাবু বিজয় কুমার দাস বদলী হয়ে অত্র বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
শিক্ষা বিস্তারের ইতিবৃত্তে এলাকার এক অনন্য ব্যক্তিদের নাম চৌধুরী আব্দুল হামিদ, যিনি এলাকায় গার্ড সাহেব নামে সমধিক পরিচিত। ইংরেজি ভাষায় তাঁর গভীর পাণ্ডিত্বের কথা আজও এলাকার গণমানুষের মুখে মুখে লোকগাঁথা হয়ে আছে। পেশা নয়, নেশার টানে যখন তখন সময়ের ফাঁকে তিনি ছুটে যেতেন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে। ক্লাসে ছাত্রদের মাঝে চেষ্টা করতেন ইরেজি শিক্ষাকে সহজ ও সাবলীল করে উপস্থাপনের।
১৯৪৬ সনে বিদ্যালয়টি ম্যাট্টিক পরীক্ষায় নিজস্ব বোর্ডে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমোদন লাভ করে। আর এই বছর স্কুল থেকে মাত্র ৭ জন ম্যাট্টিক পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে। তন্মধ্যে একমাত্র ছাত্র মোঃ রওশন আলী কৃতকার্য হন।
অধ্যক্ষ, সুশীল দত্ত তাপস
সেই চলা শুরু। বিগত ৭৪ বছরে এই বিদ্যালয় শিক্ষা বিস্তারে যে অমিয়ধারা বহমান রেখেছে, সে ধারায় দেশে বিদেশে বহু গুণীজন আজও বর্তমান। দেশ ও বিদেশে এই আলোকিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেই কোল, টোল, মক্তব, এম,ই স্কুল পরিবর্তিত হয়ে আজ এক মহীরুহের নাম বরাট ভাকলা স্কুল এন্ড কলেজ।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে বরাট ভাকলা হাই স্কুলকে কলেজে উন্নীত করা হলে বর্তমান নামটি ধারণ করে। সেইসাথে প্রধান শিক্ষকের পদবী বদলে অধ্যক্ষ হয়ে যায়। স্কুল ও কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা সুশীল দত্ত তাপস।
বর্তমানে স্কুলে শাখায় ৭৫০ জন ও কলেজ শাখায় ১২৬ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে।
(লেখক- শিক্ষক, কবি ও গবেষক) কৃতজ্ঞতায় - জীবন চক্রবর্তী, শিক্ষক - গোয়ালন্দ প্রপার হাই স্কুল