আনজুম রুহি।।
‘ফুলন দেবী’ নামটার সাথে আমরা মোটামুটি সবাই কম-বেশি পরিচিত। মারকাট, দস্যি কোন মেয়ে দেখলেই আমরা তাকে ‘ফুলন দেবী’ আখ্যা দিয়ে বসি। কিন্তু আমরা কতটুকু জানি ফুলন দেবী সম্পর্কে..? (১০ আগষ্ট ১৯৬৩ – ২৬ জুলাই ২০০১) ‘ফুলন দেবী’ দস্যু রাণী হিসেবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু তিনি ছিলেন একই সাথে নির্যাতিত নারীদের প্রতিনিধি,পরবর্তীতে রাজনীতিতেও যোগদান করেন তিনি। ভারতের নিচু বর্ণ হিসেবে পরিচিত মাল্লা বর্ণের এক গরীব পরিবারে জন্ম নেন ফুলন।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়ায় দারিদ্র্যতাই ছিলো তার সবটুকু জুড়ে। ১১ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় ‘পুট্টিলাল’ নামে বাবার বয়সী এক লোকের সাথে। ছোটবেলা থেকেই নির্যাতিত হয়ে এসেছেন ফুলন দেবী। তার আশেপাশের গ্রামে জমিদার বংশের ঠাকুরেরা এসে গ্রামের ফসল কেটে নিয়ে যেত এবং গ্রামের মানুষদের উপর নির্যাতন চালাত। ফুলন দেবী প্রতিবাদ জানিয়ে দখলদার নেতা ‘মায়াদীন’র বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলে ঠাকুররা প্রতিশোধ নিতে তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং তার উপর চালাতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। ২৩ দিন যাবত ঠাকুর ও তার লোকেরা ধর্ষণ করে ফুলনকে। একদিন মৃত ভেবে ফেলে রেখে গেলে সেই সুযোগে পালিয়ে যান ফুলন। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর।
১৯৭৯ সালে ‘মায়াদীন’ চুরির অভিযোগে ফুলনকে গ্রেফতার করালে তিন দিনের কারাবাস হয় তার। কারাবাসের রক্ষকদের দ্বারাও ধর্ষিতা হয় ফুলন দেবী। কারাবাস থেকে ফেরার পর পরিবার ও গ্রাম থেকে বিতাড়িত হন তিনি। ফুলন দেবী আরেকবার ধরা পড়েন এক দস্যু দলের হাতে, এবং দস্যুদের নেতা বাবুর নজর পড়ে ফুলনের ওপর। কিন্তু আরেক দস্যু বিক্রম এতে বাঁধা হয়ে দাড়ায় এবং বাবুকে খুন করে ফুলনকে রক্ষা করে সে। এরপর ফুলনের সঙ্গে বিক্রমের বিয়ে হয় এবং শুরু হয় ফুলনের নতুন জীবন। রাইফেল চালানো শিখে পুরোদস্তুর ডাকাত বনে যান ফুলন দেবী। ডাকাত দলে যোগদান করার পর তিনি প্রথমেই তার প্রাক্তন স্বামী ‘পুট্টিলাল’ এর গ্রামে আক্রমণ চালান। ফুলন পুট্টিলালকে জনসমক্ষে শাস্তি দেন এবং প্রায় মৃত অবস্থায় ‘পুট্টিলাল’কে ফেলে রেখে যান।
এর মধ্যেই একদিন ধনী ঠাকুর বংশের ছেলের বিয়েতে সদলবলে ডাকাতি করতে যান ফুলন। সেখানে ফুলন খুঁজে পান এমন দুজন’কে যারা তাকে ধর্ষণ করেছিলো। ক্রোধে উন্মত্ত ফুলন দেবী আদেশ করেন বাকী ধর্ষণকারীদের ধরে আনার। কিন্তু বাকিদের পাওয়া না যাওয়ায় লাইন ধরে ঠাকুর বংশের ২২ জনকে এক সঙ্গে দাড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। বেমাইয়ের এই গণহত্যা ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফুলনকে ধরার জন্য ব্যাস্ত হয়ে উঠে সরকার আবার ফুলনের পক্ষেও ভারতজুড়ে চলে আন্দোলন।
একপর্যায়ে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সরকার সন্ধি প্রস্তাব করেন এবং ফুলন দেবী সন্ধির জন্য বেশ কিছু শর্ত দেন। সরকার শর্ত মেনে নিলে ১০,০০০ মানুষ এবং ৩০০ পুলিশের সামনে ‘মহাত্মা গান্ধী’ আর ‘দুর্গা’র ছবির সামনে অস্ত্র সমর্পণ করেন ফুলন দেবী। ১১ বছর কারাভোগের পর ফুলন দেবী সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ এবং ‘৯৯-তে পরপর দুইবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ২৬ জুলাই সংসদ থেকে বের হয়ে আসার সময় নয়া দিল্লিতে ফুলন দেবীকে হত্যা করা হয়। ঠাকুর পরিবারের তিন ছেলে শের সিং রাণা, ধীরাজ রাণা এবং রাজবীর ফুলন দেবীকে এলোপাতাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায়।
হত্যাকারীরা পরবর্তীতে প্রকাশ করেন যে বেহমাই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তারা ফুলন দেবীকে হত্যা করে। দস্যু হবার সাথে সাথে নির্যাতিত নারীদের প্রতীকও ছিলেন ফুলন দেবী। তার অপরাধ জীবনের বেশিরভাগ অপরাধই সংঘটিত করেছেন নির্যাতিত নারীদের হয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য। দস্যু হওয়া সত্ত্বেও অনেকে তাকে ‘মায়াদেবী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। পরবর্তীতে ফুলন দেবীর জীবন কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দস্যুতার পাশাপাশি দয়া এবং মমতা দিয়েও অনেকের মন জয় করেছিলেন গরীবের ‘রবিনহুড’ খ্যাত কিংবদন্তী এই ডাকাত সর্দার ‘ফুলন দেবী’।
( লেখক, আনজুম রুহী, ঢাকা)