নির্মলেন্দু কুন্ডু।।
আজ যে বিদ্যাপীঠটি পূর্ণাঙ্গরূপে বহিঃপ্রকাশ করে অত্র এলাকার ছেলে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করছে, তার নাম গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। শিশু যেমন ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়, এ বিদ্যালয়টির ক্ষেত্রেও তেমনি ঘটেছিল। আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগে বিদ্যালয়টির নাম ছিল গোয়ালন্দ ME স্কুল। পুরো নাম গোয়ালন্দ Middle English School. অনেকে মুখে মুখে এ বিদ্যালয়টিকে Minor School বলেও অভিহিত করতেন।
তৎকালিন সময়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ করলে তাকে Minor Pass বলা হত। সে সময়ে প্রথম হতে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ক্লাস চালু ছিল। প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত বাবু নগেন্দ্র নাথ লাহিড়ী।
ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠক্রম শেষ হলে অভিভাবকরা বিপাকে পড়তেন। ছেলে কোথায় পড়বে। মেয়েদের কথা উল্লেখ না করার কারন সে যুগে গ্রাম্য মেয়েরা স্কুলে পড়বে এটা ছিল চিন্তার বাইরে। কিছু কিছু সচেতন অভিভাবক ছেলেদেরকে রাজবাড়ী পাঠাতেন। আমার পিতার কাছে শুনেছি তিনিও খুব কষ্ট স্বীকার করে রাজবাড়ী R.S.K Institution এ পড়াশুনা করেছিলেন।
রাজবাড়ী যাওয়াটাও সহজ সাধ্য ছিল না। কালিতলা নামে একটি জায়গায় রেল স্টেশন ছিল। সেখান থেকে দুই একটি সাটেল ট্রেন রাজবাড়ী যাতায়াত করত। সকালের দিকে বাড়ি থেকে বের হলে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে হত। এমনি কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এতদঞ্চলের ছেলেরা পড়াশুনা করত। অনেকে মাইনর পাশ করেই অথবা তার আগেই যবনিকাপাত ঘটাত।
এহেন পরিস্থিতিতে এলাকাবাসী অত্র এলাকায় একটি হাই স্কুলের অভাব অনুভব করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪২ সনের শেষ ভাগে কতিপয় সুধিবৃন্দু M.E স্কুলটিকে হাই স্কুলে উন্নীত করার চিন্তা ভাবনা করেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৩ সনে বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণি, ১৯৪৪ সনে ৮ম শ্রেণি এবং ১৯৪৫ সনে নবম ও দশম শ্রেণি খোলা হয়।
সে সব সুধিবৃন্দ তৎকালিন সময়ে বিদ্যালয়টির জন্য কিছু করেছেন তাঁদের মধ্যে শ্রী সারদা প্রসাদ দাশগুপ্ত, মরহুম বাহাদুর আলী, শ্রী অবিনাশ চন্দ্র দাস, মরহুম হানিফ মোল্লা, সুশীল বাবু, মরহুম তাজউদ্দিন আহমেদ, মরহুম মশিউর রহমান উল্লেখযোগ্য।
মরহুম বাহাদুর আলী, সে সময়ে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার নামে উজানচর ইউনিয়নে একটি বিখ্যাত গ্রাম আছে।
মরহুম তাজ উদ্দিন আহমেদ তখন বি এ পাশ করে ফরিদপুর হাই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ করে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সক্রিয় অংশ গ্রহন করেন এবং শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৮ সনে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক হন। পরবর্তী ১৯৬২ সন হতে ১৯৭৩ সন পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
সরকারি ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন যারা তারা ছিলেন তৎকালিন সময়ের মহকুমা প্রশাসক জনাব নাজির উদ্দিন সাহেব, যার স্মৃতি বহন করে আজও বিদ্যালয়টি মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।
আর একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন যিনি বিদ্যালয়টির Recogition এর ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। তিনি হলেন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা মন্ত্রী মরহুম তমিজ উদ্দিন খান। যার বাড়ী ছিল খানখানাপুর। তিনি কোন এক সময় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পীকার ছিলেন।
বিদ্যালয়টির নামকরণঃ
বিদ্যালয়টির নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে গুঞ্জন শুরু হয়। কেউ কেউ মত দিলেন সারদা বাবুর নামে বিদ্যালয়টির নাম হবে। আবার কারো মতে বাহাদুর আলীর নামে স্কুলটি হবে। অন্য এক মহল থেকে কিছু লোক মত দিলেন গোয়ালন্দ পাবলিক একাডেমী নামে স্কুলটি হবে। টাকা পয়সার ব্যাপারে গোয়ালন্দের সর্বস্তরের জনসাধারণ সাহায্য সহযোগিতা করে ছিলেন। তবে মারোয়ারিদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। পদাধিকার বলে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। যে দিন মিটিংএ স্কুলের নাম করন করা হবে সে দিন সবাই প্রায় নির্বাক। কে কার নাম প্রস্তাব করবে? এমন এক নির্জন মুহূর্তে কোন এক সুচতুর ব্যক্তি মহকুমা প্রশাসকের নাম প্রস্তাব করায় সমস্ত জল্পনা, কল্পনার অবসান হয়।বিদ্যালয়টির নাম করণ করা হয়,
“গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন হাই ইংলিশ স্কুল।
১৯৪৫ সনে M.E স্কুলটি একত্রিকরণ করে হাই স্কুলে উন্নীত করা হয়েছিল। বাবু অমূল্য প্রসন্ন ঘোষ প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৫৭ সনে পদ্মার করাল গ্রাসে স্থানান্তরিত হয়েছিল বর্তমান সরকারি গুদামের পাশে আজ যেখানে নিজামিয়া মাদ্রাসা।
১৯৬২ সনে পাকিস্তান সরকার কিছু কিছু বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কোর্স চালু করে ফলে বিদ্যালয়টিও সেই স্কিমের অর্ন্তভুক্ত হয়।
বিদ্যালয়টি আবারও ভাঙ্গনের পতিত হবে এ আশংকায় বিজ্ঞান ভবনটি যথাস্থানে নির্মাণ করা যাবে না বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন মাননীয় মহকুমা প্রশাসক, সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য কর্মকর্তাগণ। বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত না হলে বিজ্ঞান গ্রান্ট দেয়া যাবে না সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি বিপাকে পড়ে বাধ্য হলেন বিদ্যালয়ের ঘরটি আবারও সরাতে। বিজ্ঞান কোর্স চালু হওয়ায় বিদ্যালয়টির নাম হলো ‘ গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়।
১৯৬২ সনের মধ্যেই ১ম – ৫ম শ্রেণির বিলুপ্ত হয়। ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে বর্তমান ভবনটি চালু হয়।
(১৯৬৭ সালের স্কুলের পুরাতন ছবি)
১৯৭৫ সালের দিকে থানা পর্যায়ে কিছু কিছু বিদ্যালয়কে পাইলট স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করলে এই স্কুলটিও সে আওতায় আসে। ফলে বিদ্যালয়টির নাম ‘ গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।
১৯৮৪ সনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সনের ১ সেপ্টেম্বর হতে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। ফলে বিদ্যালয়টির বর্তমান নাম ধারণ করেছে, গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
(লেখক, নির্মল কুন্ডু, বিএ বিএড, অত্র স্কুলের প্রাত্তন ছাত্র ও শিক্ষক
লেখা সংগ্রহ, এস, এম, সিরাজুল ইসলাম, প্রাত্তন ছাত্র, বর্তমান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে কর্মরত।
ফটোক্রেডিট, Bappy