মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপতাল: অপারেশন থিয়েটারে স্থাপনের আগেই গায়েব হয়ে যায় ৯ মেশিন

ষ্টাফ রিপোর্টার | রাজবাড়ী টেলিগ্রাফ / ১৪১ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ আপডেট : বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

0Shares

সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি, ১৫ ফেব্রুয়ারী

মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপতালের অপারেশন থিয়েটারে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের ১০টি বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিনের ৯টি না বসিয়েই গায়েব করে দেয়া হয়েছে। সিএমএসডি কর্তৃক ১০টি মেশিন সরবরাহ করা হলেও মাত্র একটি মেশিন বসিয়ে বাকিগুলো গায়েব করে দেয়ার পেছনে রয়েছে হাসপাতালটির তৎকালীন তত্বাবধায়ক ডা: আরশ্বাদ উল্লাহ, সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনী) ডা: রুমা আক্তার, স্টোরকিপার লুৎফর রহমান ও সংশ্লিষ্ট মেশিন সরবরাহকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সানী ট্রেডিং এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। ঘটনাটি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে সাজানো হয়েছে চুরির ঘটনা। এ ঘটনায় ওটি ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স জান্নাত আরা আক্তারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

হাসপাতাল ও ওটি ইনচার্জ জান্নাত আরা আক্তারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সিএমএসডি কর্তৃক সরবরাহকৃত ১০টি বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন একই বছরের ২৯ নভেম্বর স্থাপন (ইনস্টল) করা হয়। সম্প্রতি সম্পদ ব্যবস্থাপনার অনলাইন এন্ট্রি করার জন্য পরিদর্শনকালে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপতালের অপারেশন থিয়েটারে মেশিনগুলোর হদিস মেলেনি।

মেশিনগুলো গায়েব হওয়ার ঘটনায় হাসপাতালটির ওটি ইনচার্জ জান্নাত আরা আক্তার, স্টোরকিপার লুৎফর রহমান ও তৎকালীন তত্বাবধায়ক ডা: আরশ্বাদ উল্লাহ একে অপরকে দোষারোপ করলেও তদন্ত কমিটি গঠনের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো মেশিন চুরির রহস্য উদঘাটন হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপতালে তিনটি অপারশেন বিভাগ রয়েছে। যেগুলো হচ্ছে গাইনী, সার্জারী, চক্ষু, নাক-কান-গলার বিভাগ। এরমধ্যে গাইনী, সার্জারী বিভাগে অপারেশন করতে বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন প্রয়োজন হয়। চক্ষু অপারেশনের ক্ষেত্রে মেশিনটির প্রয়োজন হয়না। আর নাক-কান-গলার অপারেশন সার্জারী বিভাগে করা হয় বিধায় অতিরিক্ত বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিনের প্রয়োজন নেই।

সরেজমিনে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপতালের অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখা গেছে, গাইনী ও সার্জারী বিভাগে দুইটি করে মোট ৪টি অপারেশন টেবিল রয়েছে। প্রতিটি অপারেশন টেবিলের সাথে বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন লাগানো রয়েছে। এসব মেশিনগুলো ২০২০ সালের পূর্বেই লাগানো হয়েছিল। হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটারে নতুন কোন অপারেশন টেবিল ও বায়োপোলার ডাপয়াথেরামি মেশিন বসানোর মত পর্যাপ্ত জায়গা নেই।

হাসপাতালটির অপারশেন থিয়েটারে পর্যাপ্ত বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন থাকা সত্ত্বেও নতুন করে ১০টি বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন স্থাপনের কারণ নিয়েও রয়েছে বিস্তর রহস্য। হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটারে নতুন করে ১০টি বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন স্থাপনের পর্যাপ্ত জায়গাও নেই, এমনি যে কাজে এটি ব্যবহৃত হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য যন্ত্রপাতিও নেই বলে জানান অপারেশন থিয়েটার সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টি নিয়ে মেশিন স্থাপনের উল্লেখিত সময়ে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপতালের গাইনী ওয়ার্ডে চিকিৎসা সেবা প্রদানে নিয়োজিত একাধিক চিকিৎসকের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন অপারেশন থিয়েটারে আগে থেকেই বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন ছিল। কিন্ত সেসময় নতুন করে বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে কি’না জানা নেই।

এছাড়া, মেশিন স্থাপন শেষে সনদপত্র ও সেসময় উপস্থিত কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। মেশিন স্থাপনের সনদপত্রে মেশিনের সিরিয়াল নাম্বারগুলো ও মেশিনের সংখ্যা হাতে লেখা হয়েছে। এছাড়া সর্বপ্রথম ওটি ইনচার্জ, এরপর মেশিন স্থাপনের সময় উপস্থিত কর্মকর্তা ও সবশেষ তত্বাবধায়কের স্বাক্ষর করার কথা থাকলেও সবার আগে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন তত্বাবধায়ক ডা: আরশ্বাদ উল্লাহ। ডা: আরশ্বাদ উল্লাহ’র স্বাক্ষর করার ৫ দিন পর স্বাক্ষর করেন মেশিন স্থাপনের সময় উপস্থিত কর্মকর্তা ডা: রুমা আক্তার।

বিষয়টি নিয়ে ওটি ইনচার্জ জান্নাত আরা আক্তার বলেন, আমি কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়েছি। ওই সময়ে মাত্র একটি মেশিন স্থাপন করা হয়েছিল। সনদপত্রে আমার স্বাক্ষরের পর বাকি মেশিনের সিরিয়াল নাম্বারগুলো হাতে লেখা হয়েছে। যে একটি মেশিন বসানো হয়েছিল সেটি বর্তমান তত্বাবধায়ক স্যারে জিম্মায় আছে। আর কোন মেশিন বসানোও হয়নি, আমি সেগুলোর বিষয়ে কিছু জানিও না।

তিনি আরো বলেন, অপারেশন থিয়েটারে যতগুলো অপারেশন টেবিল আছে ততগুলো বায়োপোলার ডায়াথার্মি মেশিন আছে। আগের গুলো এখনো সক্রিয় আছে। তাহলে নতুন মেশিন কোথায় কি প্রয়োজনে লাগাবে? আর নতুন ১০টি মেশিন যে বসাবে এখানে তো সেই পরিমাণ জায়গাই নাই। তাহলে মেশিনগুলো বসালো কোথায় এই প্রশ্ন করলেই আপনারা আসল ঘটনা জানতে পারবেন।

স্টোরকিপার লুৎফর রহমান বলেন, ১০টি মেশিন আমি রিসিভ করেছিলাম। এরপর মেশিনগুলো অপারেশন থিয়েটারে স্থাপন করার পর ইনচার্জ জান্নাত আরা আক্তারকে বুঝিয়ে দিয়ে তার স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। আর সনদপত্র ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ফরম্যাট করা থাকে। তারা ফরম্যাট ঢাকা তেকে নিয়ে এসেছে। মেশিনের প্যাকেট খোলার পর স্থাপন করা হয় এবং তখন সিরিয়াল নাম্বার দেখে ফরম্যাটে লেখা হয়।

তবে মেশিন সরবরাহকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সানী ট্রেডিং এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে মেশিন স্থাপনকারী ইঞ্জিনিয়ার রবিউল ইসলাম জানান, অপারেশন থিয়েটারে আমি ১০টা মেশিন স্থাপন করে দিয়ে এসেছি। এর বাইরে আমি কিছু জানিনা। অপারেশন থিয়েটারে ১০টি মেশিন স্থাপনের জায়গা না থাকা সত্ত্বেও কিভাবে ১০টি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে জানতে চাইলে সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

সনদপত্রে নির্দিষ্ট সময়ের পরে স্বাক্ষর করার কারণ জানতে ডা: রুমা আক্তারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রাগান্বিত স্বরে বলেন, আপনারা আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন? আপনাদের কিছু জানার থাকলে তত্বাবধায়কের সাথে কথা বলেন। আমি ডাক্তার, আমার কাজ চিকিৎসা সেবা দেওয়া। মেশিন সংক্রান্ত বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এ বিষয়ে আমাকে একটাও প্রশ্ন করবেন না।

মেশিন স্থাপনের পর অপারেশন থিয়েটারে সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন কি’না এবং ডা: রুমা আক্তারের স্বাক্ষর ৫ দিন পরে দেওয়া হয়েছে কেন জানতে চাইলে তৎকালীন তত্বাবধায়ক ডা: আরশ্বাদ উল্লাহ বলেন, মেশিন স্থাপনের পর আমি অপারেশন থিয়েটারে পরিদর্শন করেছিলাম। ডা. রুমা আক্তার পরে স্বাক্ষর দিয়েছে কেন সেটা আমার জানা নেই।

অপারেশন থিয়েটারে পুরাতন ডায়াথার্মি মেশিন থাকার পরও নতুন ১০টি মেশিন কোথায়, কি কাজে বসানো হয়েছে জানতে চাইলে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি ডা: আরশ্বাদ উল্লাহ।

এ ব্যাপারে গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতি সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী) ডা: জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ সারোয়ার বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান। এ নিয়ে এখনই কোন মন্তব্য করতে পারবো না। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলতে পারবো।

Facebook Comments


এ জাতীয় আরো খবর
NayaTest.jpg