স্টাফ রিপোর্টার, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে মুজিববর্ষের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে ‘ক’ শ্রেনীর ঘর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র দিন মজুর পরিবারের বরাদ্দকৃত অর্ধ নির্মিত ঘর ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক বিএনপি নেতা, কলেজ শিক্ষক পরিবারের বিরুদ্ধে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে উপজেলার ছোটভাকলা ইউনিয়নের কৃষ্ণপট্রি এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। উপজেলা প্রশাসন এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
স্থানীয় চর আন্ধারমানিক এলাকার সেকেন মোল্লার ছেলে সরকারি গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও উপজেলা জিয়া পরিষদের সাবেক সম্পদক মন্ডলীর সদস্য নজির হোসেন মোল্লা, তার বড় ভাই গোয়ালন্দ বাজারের চাউল ব্যবসায়ী মো. ফজল মোল্লা, বোন বালিয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রাশেদা খাতুন এবং বোন জামাই উপজেলা কৃষি বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. মিলন মন্ডলের বিরুদ্ধে ভাঙচুরে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর ডিজাইন অনুযায়ী গোয়ালন্দ উপজেলায় ১০০টি ঘর নির্মাণ হচ্ছে। এর আগে আরো ৫০টি ঘর হয়েছে। নতুন ১০০টি ঘরের মধ্যে স্থানীয় কৃষ্ণপট্রি এলাকার মৃত ছাত্তার শেখ এর ছেলে আকরাম শেখ এর নামে একটি ঘর বরাদ্ধ হয়। সরকারি দুই শতাংশ জমির ৪০০ বর্গফুট জায়গার ওপর নির্মিত প্রতিটি পাকা ঘরের সামনের বারান্দাসহ দুটি শয়ন কক্ষ, পিছনে রান্না ঘর ও শৌচাগার রয়েছে। ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা ব্যায়ে প্রতিটি মুজিববর্ষের ঘর তৈরী হচ্ছে। ঘর নির্মাণ বাস্তবায়নে দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি। এর সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। সদস্য হিসেবে সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগন।
ক্ষতিগ্রস্ত আকরাম শেখ অভিযোগ করেন, প্রায় ৩০ বছর আগে তার বাবা ছাত্তার শেখ কৃষ্ণপট্রি এলাকার ৭ শতাংশ জায়গা লিখে দেন। সেই জমি নজির হোসেন মোল্লাদের দাবি করে মামলা করা হয়। তবে দীর্ঘদিন মামলা চালানোর পর কোর্ট থেকে ডিক্রি পাই। সেখানে ঘর তোলার সামর্থ না থাকায় ঘর করতে পারিনি। স্ত্রী, মা ও তিন সন্তান নিয়ে শ্রমিকের কাজ করে অন্যের বাড়িতে বাস করছি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় উপজেলা প্রশাসন থেকে তার নামে সরকারি পাকা ঘর বরাদ্দ হয়। গোয়ালন্দ পৌরসভা ১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার রাজমিস্ত্রী নুরু সরদার ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। প্রায় তিন ফুট উঁচু করে চারপাশের পাকা ডোয়া নির্মাণ শেষ হলে গত মঙ্গলবার (৭ জুন) সন্ধ্যার দিকে নজির মোল্লার বড় ভাই ফজল মোল্লা, তার স্কুল শিক্ষিকা বোন রাশেদা খাতুন লোকজন নিয়ে রাজ মিস্ত্রীদের মারধর করে সবাইকে তাড়িয়ে দেন। এসময় তারা ঘরের চারপাশের পাকা ডোয়া লোহার শাপোল দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দেন। আমাকে মারার জন্য খুঁজতে থাকলে ভয়ে দূরে পালিয়ে ছিলাম। রাজমিস্ত্রীদের মারধর ঘর ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ পেয়ে রাতেই ইউপি চেয়ারম্যানকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সত্যতা পান ইউএনও আজিজুল হক খান।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বলেন, এই জায়গা নিয়ে অনেকদিন ধরে ঝামেলা চলে আসছিল। তবে এর ডিক্রি আকরাম শেখ পায়। আমরা জানি যে এই জমি আকরাম শেখেরই। দীর্ঘদিন পর সরকারের পক্ষ থেকে ঘর পেলে কাজ শুরু করা হয়। তবে ঘরের ডোয়ার কাজ হওয়ার পর গত মঙ্গলবার ৭ জুন নজির হোসেনের পরিবার তা ভেঙে ফেলে।
নির্মাণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়ালন্দ পৌরসভা ১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার রাজমিস্ত্রী নুরু সরদার বলেন, আমার ভাই বিল্লাল সরদার সহ ৫জন লোক কাজ করছিল। নজির প্রফেসারের পরিবারের লোকজন সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে ভাঙচুর চালায়। বারণ করলেও না শুনে তিন ফুট ৩ ইঞ্চি উচুঁ করা চারপাশের সম্পূর্ণ ডোয়া ভেঙ্গে মাটিতে মিশিয়ে দেয়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন বলেন, আকরামের বাবার নামের জমির দলিল রয়েছে। ওই জমি মিউটিশন করা হয়েছে। সেখান থেকে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের নামে দুই শতাংশ জমি লিখে দেওয়ার পর আকরামের মুজিববর্ষের পাকা ঘরের কাজ শুরু হয়। মুজিব বর্ষের ঘর ভাঙলে কি ক্ষতি হবে বুঝতে না পেরে নজির প্রফেসরের পরিবার মামলা আছে এই অজুহাতে ঘরের পাকা ডোয়া ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। এখন নতুন করে নজির প্রফেসরের পরিবার জমি বুঝ করে দিচ্ছেন। সেখানেই আকরাম শেখ এর ঘরের কাজ হবে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত কলেজ শিক্ষক নজির হোসেন মোল্লা বলেন, এটা মুজিব বর্ষের ঘর আমার বড় ভাই বা বোন কেউ বুঝতে পারেনি। ওই ঘর ভাঙচুরের সময় আমি ঘটনাস্থলেও ছিলামনা। এছাড়া যে জমিতে ঘর তৈরী হচ্ছিল সেটা আমাদের নিজস্ব পৈত্রিক সম্পত্তি। এই জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান আছে। শীঘ্রই আমরা আদালতের রায় পাব। তারপরও যেহেতু ভুল করে ফেলেছে এজন্য ওই জমির মাথায় থেকে আমরা দুই শতাংশ জমি লিখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ঘর নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ইউএনও আজিজুল হক খান বলেন, ভাঙচুরের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সরকারি গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক নজির হোসেন মোল্লাসহ বোন জামাই উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিলন মন্ডলকে ডেকে এনেছিলাম। তাদেরকে বুধবারের মধ্যে ঘরের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে নির্দেশনা প্রদান করেছিলাম। দুই দিন পার হলেও পদক্ষেপ না নেয়ায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।