লক্ষীকোলে বিখ্যাত একছিল
ও ভাই রাজার বাড়ি।
ফলে ভরা ফসলে ভরা
স্মৃতি ভরা রাজবাড়ী।-মোঃ ইদ্রিস মিয়া ময়না
রাজবাড়ীর সেই রাজা নেই কিন্তু রাজবাড়ী জেলা আজও রাজার সেই ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। পদ্মা, হড়াই, গড়াই, চন্দনা, কুমার আর চিত্রার পলিবাহিত এককালের ‘বাংলার প্রবেশদ্বার ‘ বা ‘Gate way of Bengal’ বলে পরিচিত গোয়ালন্দ মহকুমাই আজকের রাজবাড়ী জেলা।
১৮১১ সালে ফরিদপুর জেলা সৃষ্টি হলে রাজবাড়ীকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ গোয়ালন্দ মহকুমা রাজবাড়ী জেলায় পরিণত হয়। তবে কখন এবং কোন রাজার নামানুসারে রাজবাড়ী জেলার নামকরণ করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়নি। বাংলার রেল ভ্রমণের পুস্তক (এল এন মিশ্র প্রকাশিত ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ক্যালকাটা ১৯৩৫) পাওয়া তথ্যমতে শায়েস্তা খান সংগ্রাম শাহকে জলদস্যু দমনের জন্য নায়ের করে পাঠান। তিনি বাণীবহতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং লালগোলা নামক স্থানে দূর্গ নির্মাণ করেন। লালগোলার এই দূর্গ স্বদেশীয়দের নিকট রাজবাড়ী নামে পরিচিত ছিল এবং রাজকাচারিতে কাগজে-কলমে রাজবাড়ী লেখা হতো। মতান্তরে রাজা সূর্য কুমারের নামানুসারে রাজবাড়ী জেলার নামকরণ করা হয়। পলাশী যুদ্ধের পর দ্বিজেন্দ্র প্রসাদের পিতা(যিনি ছিলেন রাজা সিরাজউদ্দৌলার রাজ কর্মচারী) এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং তার বাড়ীই সকলের কাছে রাজবাড়ী নামে পরিচিত ছিল। তার পুত্র সূর্য কুমার ১৮৮৫ সালের জনহিতকর কাজের জন্য রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন।
রাজবাড়ী ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গের এলাকা। বঙ্গের মানুষের সাধারণ জীবনচারিতা ছিল সহজ -সরল ও আড়ম্বরহীন। রাজবাড়ী জেলার মানুষের মধ্যে জীবন-যাপন,খাদ্য ও কাজকর্ম, চলাচল,বাসভূমি প্রভৃতিতে বৈচিত্র্য আছে। এছাড়া ভাব প্রকাশ, বাক্য রীতি আদান -প্রদান এবং ভাষা ব্যবহারত্ত্বে অঞ্চল ভিত্তিক বিশেষত্ব আছে। মূলত এগুলো তাদের শত শত বৎসরের লোকজ মানুষের মোটিফের প্রকাশ। কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী থেকে থেকে কিছু কিছু মানুষের অভিবাসন ঘটে। তন্মধ্যে অন্যতম ছিল পাবনা। এককালে রাজবাড়ী ছিল হিন্দু প্রধান। বর্তমানেও হিন্দু আছে। হিন্দু -মুসলমানেরা এখন সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে বের হয়ে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে মিলেমিশে বসবাস করছে।
রাজবাড়ী জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি জেলা। এর পূর্বে মানিকগঞ্জ, পশ্চিমে কুষ্টিয়া, উত্তরে পাবনা এবং দক্ষিনে ফরিদপুর ও মাগুরা জেলা। ২৩.৪৫ ডিগ্রি উত্তর এবং ৮৯.০৯ ডিগ্রি পুর্ব দ্রাঘিমাংশ। রাজবাড়ী জেলার আয়তন ৪৩১.৯৭ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ১০,১৫,৫১৯ (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী)। জনসংখ্যার ঘনত্ব ২৪০০/বর্গমাইল। রাজবাড়ী জেলায় ২ টি নির্বাচনী এলাকা,৫টি উপজেলা, ৫টি থানা,৩টি পৌরসভা,৪২টি ইউনিয়ন এবং ১০৩৬টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত। এখানে ৬টি নদী এবং ৪৮টি বদ্ধ জলমহল রয়েছে। মোট আবাদী জমি ১,১২,৭৭৬ হেক্টর। কৃষি পরিবার ১,৮১,৪০৯টি। শিক্ষার হার ৫২.৩% এবং হোমিওপ্যাথি কলেজ ১টি,ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ৪টি,স্যাটেলাইট স্কুল ১৩টি,কমিউনিটি স্কুল ৯টি,মহাবিদ্যালয় ২৫টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০০টি ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪০৮টি রয়েছে। ১টি সরকারি হাসপাতালসহ ৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ২৮টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। নিরাপদ পানি ব্যাবহারকারীর পরিমান ১০০% এবং শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ১৮ জন। আবাসন প্রকল্প ৪টি (১টি বাস্ববায়নাধীন) ও আশ্রয়ন প্রকল্প ২টি রাজবাড়ীতে চলমান। রাজবাড়ী জেলায় আদর্শ গ্রামের সংখ্যা ১০টি।
মুক্তিযুদ্ধেও এ জেলার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। রাজবাড়ীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথম প্রবেশ করে ২১ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে। হানাদার বাহিনী এবং বিহারীরা মিলে রাজবাড়ীতে হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। রাজবাড়ী জেলার অনেক বীরসন্তান সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং যুদ্ধের ট্রেনিং হয় রাজবাড়ী রেলওয়ে মাঠে। রাজবাড়ী হতে অনেকে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করে। রাজবাড়ীতে মোটামুটি ৮টি মুক্তিবাহিনী গ্রুপ কাজ করে। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও রাজবাড়ী স্বাধীন হয় ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এবং স্বাধীন বাংলদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন নজিবর রহমান।
আমাদের এই ছোট জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক গুণীজন। মহাকাব্য বিষাদসিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের পৈতৃক নিবাস রাজবাড়ী জেলায়। তিনি উপন্যাস, নাটক, জীবনী ও ইতিহাসগ্রন্থ, ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ও সংগীত নিয়ে ৩৫টি গ্রন্থ রচনা করেন। আমাদের উপহার দিয়েছেন বসন্তকুমারী ও জমিদার দর্পণের মতো কালজয়ী সৃষ্টি। দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, পরিসংখ্যানবিদ এবং দাবাড়ু ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন রাজবাড়ী জেলারই কৃতি সন্তান। তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। সাহিত্য সাধনা, রাজনৈতিক সচেতনতা ও শিক্ষা সংস্কার দ্বারা মুসলমানদের অগ্রগামী করার অন্যতম পুরোধা ব্যাক্তিত্ব ইয়াকুব আলী চৌধুরী রাজবাড়ী জেলার মহান পুরুষ। ব্যবহারিক শব্দ কোষের নির্মাতা কাজী আব্দুল ওদুদ এবং ফাইন আর্ট এ ২১শে পদক প্রাপ্ত মনসুরুল করিম, বীর বিক্রম শহীদ খবিরুজ্জামান,কাঙ্গালিনী সুফিয়া, ক্রিকেটার সোহেলি আক্তার এ জেলারই গর্ব।
রাজবাড়ী জেলা প্রাচীনকাল থেকেই যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নত। ১৮৯০ সালের রাজবাড়ী রেল-স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজবাড়ী জেলায় রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। রাজবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের লাল ভবন এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষণে আছে। এছাড়াও রাজবাড়ীর বিখ্যাত স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে নীলকুঠি, কল্যাণ দিঘি, শাহ -পাহলেয়ানের মাজার,নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির,চাঁদ সওদাগরের ঢিবি,রথখোলা সানমঞ্চ, গোদার বাজার ঘাট,জামাই পাগলের মাজার,গোয়ালন্দ ঘাট এবং দৌলতদিয়া ঘাটসহ আরও বেশ কিছু স্থান।
ইষ্টি-কুটুম বাড়িতে বেড়াতে এলে রাজবাড়ীয়ানরা আনন্দিত হয়। চিতই পিঠা, রুটি পিঠা,মুরগির গোশত,ভাপা পিঠা,পুলি পিঠা আমাদের প্রিয় খাবার। ইলিশ, কৈ, মাগুর,শোল মাছ রাজবাড়ীয়ানদের প্রিয় খাবার। রাজবাড়ীর খেজুর গুড় এবং চমচম দেশখ্যাত।
প্রাচীন ঐতিহ্যের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে রাজবাড়ী জেলায়। এদের রয়েছে নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা। ঢেঁকি নাচ, জারি নাচ, সারি নাচ, ছোকরা নাচ, কীর্তন নাচ, বৃষ্টি নামানোর নাচ, ঘেটু নাচ ইত্যাদি লোকনৃত্য এবং আঞ্চলিক গানের প্রচলন রয়েছে রাজবাড়ীতে। উদিচি শিল্পী গোষ্ঠী, রবীন্দ্র সংগীত, সম্মিলন পরিষদ, মুক্তিপাঠ চক্রসহ মোট ১২টি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে রাজবাড়ীতে।
মানব সংস্কৃতির ধারায় রাজবাড়ী জেলার উৎসব প্রকৃতির ধারায় বিকশিত হয়েছে।উৎসবপ্রিয় রাজবাড়ী জেলাবাসী সুযোগ পেলেই উৎসবে মেতে ওঠে। গ্রাম্য মেলা,সার্কাস,নববর্ষ, নৌকা বাইচ,হালখাতা,পালাগান,লাঠিখেলা,পুতুলনাচ সহ আরও অনেক ধরনের উৎসব পালন করে থাকে।
বুনো,বাগদি, বেহারা, বিন্দি, কোল ইত্যাদি আদিবাসীর বসবাস রয়েছে রাজবাড়ী জেলায়।
রাজবাড়ী জেলার নিজস্ব কিছু পত্র -পত্রিকা ও সাময়িকী রয়েছে। অনুসন্ধান (১৯৮৪),সহজ কথা, রাজবাড়ী কণ্ঠ, দৈনিক মাতৃকন্ঠ (রাজবাড়ী), গতকাল(রাজবাড়ী), পাংশা বার্তা, পথবার্তা, অবলুপ্ত, শাপলা, কোহিনূর, খাতক (১৮৯৩), শাপলা-শালুক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রাজবাড়ী জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। ৭৫ ভাগ লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল। এ জেলায় পাট, আখ, ধান, গম ইত্যাদিসহ কলা ও মাছ চাষ হয় । ফসলের নিবিড়তা ২৩৫। মূলত কৃষি নির্ভর হলেও ব্যবসায়ী, কামার,কুমোর,তাতী, হরিজন প্রভৃতি পেশার লোকজন রয়েছে এ জেলায়। এখানে বৃহৎ ৩টি,মাঝারি ৬টি ও ক্ষুদ্র ৭১২টি এবং কুটিরশিল্প ভিত্তিক ৫,৫৫৫ টি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।তন্মধ্যে গোয়ালন্দ টেক্সাটাইল মিল,রাজবাড়ী জুটস্ মিল,কালুখালী জুটস্ মিল উল্লেখযোগ্য। জেলাটি শিল্পে সমৃদ্ধ না হলেও অর্থনীতিতে অবদান রয়েছে।
‘যে যায় পাবনা নেই তার ভাবনা’
‘নামে খায় বেলগাছির গুড়’
‘এ কয়টাকা লাভ পেলেই আমি বালেকান্দীর ঠাকুর’ ইত্যাদিসহ রাজবাড়ী জেলার মানুষের নিজস্ব সৃষ্ট আরও অনেক প্রবাদ প্রবচন রয়েছে।এ থেকেই বোঝা যায় প্রাচীন কাল থেকেই রাজবাড়ী জেলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ।
রাজবাড়ী নামের মাঝেই যেন একটা রাজকীয়, চমকপ্রদ ও ঐতিহ্যপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে।শিল্প -মননে, শিক্ষা-সাহিত্যে, সংসস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে সর্বোপরি রাজবাড়ীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যায়ে অঙ্গীকারবদ্ধ আমরা রাজবাড়ী জেলাবাসী।
পদ্মার পাশে ছোট্ট শহর
মোদের রাজবাড়ী।
হেথা দেশ-বিদেশে যাওয়ার জন্য
আছে ও ভাই রেলের গাড়ি।-মোঃ ইদ্রিস মিয়া ময়না
লেখক: তাজমিন নাহার শিক্ষার্থী: আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।